বৈশ্বিক সম্পর্কোন্নয়ন
এম হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৬ এএম
এম হুমায়ূন কবির
অন্তর্বর্তী সরকারের
দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটের নিরিখে যাচাই করলে হবে না।
বিগত ১৫ বছরে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকাঠামো তৈরি হয়েছিল। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের
মুখে ওই সরকারের পতন ঘটে। লাখ লাখ মানুষ ওই গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত হয়। তাদের যে প্রত্যাশা
ও স্বপ্ন, তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। অন্তর্বর্তী
সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এ কথাটিই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যা নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত।
জেনারেশনাল শিফট বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরের
প্রক্রিয়াও কিন্তু এবার লক্ষ করা যাচ্ছে। এ উত্তরণের কাজটি যেন যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়
তা-ও এ সরকারকেই করতে হবে। এ তরুণ প্রজন্মই জুলাই ও আগস্টে অসাধারণ বীরত্ব ও নৈপুণ্যের
সঙ্গে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেছে এবং সফল হয়েছে। অনেকে এ আন্দোলনকে বিপ্লব বলছেন,
আবার অনেকের মতে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এটি এক ধরনের জেনারেশনাল
শিফট তো বটেই। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বিবর্তনের এ সময়ে পুরোনো অনেক কিছুই ফেলে
দিতে হয়। তবে কিছু পুরোনো, যা গ্রহণযোগ্য তা রেখেই আমাদের নতুন কাঠামো দাঁড় করানোর
কাজ করতে হবে। সেই মুহূর্ত এখন আমাদের সামনে উপস্থিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের
কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিগত সরকারের প্রস্থানে জননিরাপত্তাব্যবস্থা পুরোপুরি
ভেঙে পড়ে। জননিরাপত্তা পুনরুদ্ধার এবং প্রাসঙ্গিক সংস্কার করার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত প্রজন্মের বিবর্তনকে প্রাধান্য
দেওয়া। তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতে কাজ করার ও দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মঞ্চ তাদের গড়ে দিয়ে
যেতে হবে। কতটা করতে পারবেন তা আলাপসাপেক্ষ। হয়তো সম্পূর্ণভাবে করতে পারবেন না। কিন্তু
এ বিবর্তনের ধারাবাহিকতা যেন থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী
সরকারের ক্ষমতা সীমিত এবং স্থায়িত্ব এখন পর্যন্ত অনির্দিষ্ট। কিন্তু এ সীমাবদ্ধতার
মধ্যেও যদি তারা পথ তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেন তাহলে লাভবান হবে তরুণ প্রজন্ম। জুলাই
ও আগস্টে যে অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় সরকার আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে তা আমাদের
ইতিহাসে দুর্লভ। সরকারবিরোধী আন্দোলন অতীতেও হয়েছে। তবে এবারের আন্দোলন অনন্য এ একটি
জায়গায়। মানুষকে পশুতুল্য বিবেচনা করে যেভাবে আন্দোলন দমনের চেষ্টা হয়েছে তা মেনে নেওয়ার
নয়। আর এর ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক অভিঘাত লেগেছে। পুলিশের ক্ষেত্রে
আমরা সবচেয়ে নেতিবাচক অভিঘাত লাগতে দেখেছি। ফলে যারা এ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন
তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।
সম্প্রতি একজন
তরুণ উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, নিহতদের তথ্য তারা সংগ্রহ করেছেন। এ মুহূর্তে
আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। আহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা
করা এবং নিহতের খোঁজ নিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যারা
শহীদ হয়েছেন তাদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে।
তালিকা তৈরি করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের সম্মান জানানো ও সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করার
কাজটি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, সরকারি প্রক্রিয়ার
ক্ষেত্রে যখন আমরা কাজ শুরু করি তখন সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের জায়গা অনেকাংশে বিস্মৃত
হয়ে যাই। তরুণ প্রজন্ম এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের
এ কাজটি সম্পন্ন করা উচিত। গত এক মাসে এ কাজে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা
জানি, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামো সংস্কারে
কমিশন গঠিত হয়েছে। হয়তো অচিরেই তারা কাজ শুরু করবেন।
দ্বিতীয়ত. আমাদের
সরকারি-বেসরকারি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের
কাজ করার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার বিষয়েও জোর
দেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত কাঠামোয় যদি সমাধান না করা যায় তাহলে জরুরি বিবেচনায়
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিস্থাপনও
করা যেতে পারে। জননিরাপত্তা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নানা দুর্বল সংস্থাকে
শক্তিশালী করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। পুরোনো চিন্তার অবগাহনে নতুন কাঠামো দাঁড় করাতে
চাইলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তখন সংস্কারকাজও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়বে। বিগত
আন্দোলনে মানুষের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখা দিয়েছে তার প্রতিফলনের জন্য নতুন চিন্তার আশ্রয়
নেওয়া দরকার। তা ছাড়া বিদ্যমান সমস্যাগুলো এতটাই জটিল, যা আমরা আগে দেখিনি। এ জটিলতার
সমাধানের জন্যই নতুন আঙ্গিকে ভাবতে হবে। তা ছাড়া যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার
প্রতি জন-আস্থা একেবারেই সরে গেছে সেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা পুনর্গঠনের জন্য জরুরি
ভিত্তিতে ভাবনা করা দরকার। এ কাজটি মোটেও সহজ নয়। কয়েক মাসে তা করা সম্ভব নয়। কিন্তু
আমাদের যাত্রা করা দরকার।
তৃতীয়ত. আমাদের
অর্থনীতি এখন নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। অর্থনীতি চাঙা করার কথা আমরা প্রতিনিয়ত বলছি।
প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা অন্তর্বর্তী সরকারে যুক্ত রয়েছেন। ব্যাংক খাতে পুনর্গঠন চলছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তাদের সবার সাহায্যে
অর্থনীতি চাঙা করার কাজটি সহজ হয়ে উঠবে। দেশে এখন অর্থনৈতিক দুরবস্থা যে অবস্থায় রয়েছে
তা অতীতে আমরা কখনও দেখিনি। ফলে আমাদের অর্থনীতিতে এমনটি নতুন অভিজ্ঞতা। অনেক নতুন
কার্যক্রম আমাদের শুরু করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্বলতার
মতো নানাবিধ সংকট আমাদের সামনে। গত এক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার
সঠিক পথেই এগোচ্ছে। তারা যে পথ ধরে এগোতে চাচ্ছেন তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করলে আমাদের
অর্থনীতি ফের চাঙা হয়ে উঠবে। বিগত সরকারের প্রস্থানের পর আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির
নোংরা চেহারা প্রকাশ হয়েছে। অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণের মতো জটিলতা দেখা দিয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতির
ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অবশ্য উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আমাদের পাশের দেশ অর্থাৎ একেবারে নিকট
প্রতিবেশী ভারত এ আন্দোলন যেভাবে ব্যাখ্যা করছে তা আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির
সঙ্গে আলাপ করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও আমাদের সঙ্গে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন।
কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বক্তব্য দু-তিনটি মূল উপাদানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তারা বরাবরই
বলে আসছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত. দেশে মৌলবাদের উত্থান
ঘটছে, এমন কথাও তারা বলছেন। তা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অস্থিতিশীল হওয়ায় বিদেশি
বিনিয়োগ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ অনিশ্চয়তা আমাদের
বাণিজ্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারতের এ দুই ধরনের বক্তব্য গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে
পড়ছে। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন যাত্রা এ বক্তব্যের কারণে বৈশ্বিক মহলে বিভাজন
তৈরি করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রথিতযশা ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব অন্তর্বর্তী
সরকারের প্রধান হওয়ার পরও গোটা বিশ্ব আমাদের দেশের যাত্রা সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবনায়
রয়েছে বলে আশঙ্কা। এমনকি আমার ধারণা, পাশ্চাত্য দুনিয়াও এক ধরনের অস্বস্তিতে ভুগছে।
গণতান্ত্রিক কাঠামো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। ফলে তারা সঙ্গত
কারণেই অস্বস্তিতে রয়েছে। পশ্চিমা সহযোগীরা এ ক্ষেত্রে আমাদের ওপর বিনিয়োগের আস্থা
রাখতে পারবে কি না সে জায়গায়ও কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। গোটা বিশ্বকে আশ্বস্ত করার জন্য
অন্তর্বর্তী সরকার বরাবরই স্পষ্ট বক্তব্য রাখছে। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক তৎপরতার চাইতে
বহির্বিশ্বে দূতাবাসকেন্দ্রিক তৎপরতা বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম কতটা দৃশ্যমান
হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের তৎপরতা আরও বাড়ানো জরুরি।
নাগরিক সমাজকেও কূটনীতিতে যুক্ত করতে হবে। হাফ ডিপ্লোম্যাসি বলে যে ধারণাটি রয়েছে তাকে উৎসাহিত করা জরুরি। আমাদের সঠিক বক্তব্য আড়াল করার জন্য অনেক বৈশ্বিক শক্তি এখন সক্রিয়। এ সক্রিয়তা দূর করতে হলে আমাদের একটু আউট অব বক্স চিন্তা করতে হবে। বাড়তি উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশ্বায়নের এ যুগে বৈশ্বিক সম্পর্কের বিষয়টি নতুন প্রেক্ষাপটে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য জরুরি শানিত কূটনীতি।