× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংস্কৃতির আলো, অপসংস্কৃতির অন্ধকার

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২২ ০৮:২১ এএম

পুঁজিবাদ আমাদের সব সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে সমাজে শোষণ, বৈষম্যকে শক্ত-পোক্ত করে তুলেছে

পুঁজিবাদ আমাদের সব সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে সমাজে শোষণ, বৈষম্যকে শক্ত-পোক্ত করে তুলেছে

বিনোদনের অনেক মাধ্যম আছে বটে, তবে এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না¬Ñসব মাধ্যম সবার বিনোদন মাধ্যম না। বিনোদনের ক্ষেত্রেও সাম্য-বৈষম্যের বিষয় রয়েছে। এক সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলচ্চিত্রই ছিল বিনোদনের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম। চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের গানগুলোও মানুষের পছন্দের তালিকায় ছিল। এখনতো চলচ্চিত্রশিল্পের চরম ক্রান্তিকাল। মানুষ প্রেক্ষাগৃহ একপ্রকার ত্যাগ করেছে। চলচ্চিত্রের দর্শক আকালের প্রধান কারণই হচ্ছে, চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক অতিমাত্রার মুনাফার লোভ-লিপ্সা। স্থূল রুচিহীন চলচ্চিত্রের কারণে দর্শক ছবি দেখা অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। অথচ এক সময় সুস্থ বিনোদনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাধ্যম চলচ্চিত্রনির্ভর ছিলেন সিংহভাগ মানুষ। সেসব সুস্থ বাণিজ্যিক জনপ্রিয় ছবির গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত।

১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের দেশভাগের পর থেকে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘকাল আমাদের এখানে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বই, সাময়িকী, পত্রিকা এবং বোম্বের হিন্দি ও কলকাতার বাংলা ছবির বিশাল বাজার গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের কারণে আইয়ুব খান ভারতীয় সব প্রকাশনা, চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। কিন্তু অডিও নাটক, গানকে রোধ করা সম্ভব হয়নি। রেডিও, গ্রামাফোন রেকর্ডে, টেপ রেকর্ডারে কলকাতা কিংবা বোম্বের জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি গানের শ্রোতারা কিন্তু গান শোনা থেকে বঞ্চিত হননি। শামসাদ বেগম, মোহাম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মুকেশ, সায়গল প্রমুখ বিখ্যাত হিন্দি গানের শিল্পীদের গান আমাদের এখানে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত জনপ্রিয় সেসব গান। একইভাবে কলকাতার বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত, সতীনাথ, কিশোর কুমার, মান্না দে, আরতি মুখার্জি, সলিল চৌধুরী, জগন্ময় মিত্র, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, ভূপেন হাজারিকা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, তালাত মাহমুদ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়সহ অজস্র বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের গান আমাদের এখানে ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রের মতো বাংলা গানও তার অতীত ঐতিহ্য-মান হারিয়ে এখন দিশাহীন। মুম্বাই-দক্ষিণের চলচ্চিত্রের রিমেক নির্মাণের পাশাপাশি হালের হিন্দি গানের বেগবান স্রোতে বাংলা গানের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলা গানের হৃদয়গ্রাহী কথা ও সুর হারিয়ে গেছে। সমৃদ্ধ বাংলা গানের স্বাতন্ত্র্যও টিকে থাকেনি। বাংলা গানের চাহিদা-কদর সেখানেও আর নেই। হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলা গান এখন হিন্দির একচ্ছত্র দখলদারিত্বে। সারকথা হচ্ছে বাঙালির প্রদেশ পশ্চিম বাংলায় ভাষা ও সংস্কৃতি হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে এখন নিমজ্জিত, একইভাবে হিন্দি বলয়ের হিন্দু জাতীয়তাবাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও পশ্চিম বাংলায় প্রচণ্ডভাবে ব্যাপৃত। পশ্চিম বাংলার দর্শকদের বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখার সুযোগ না থাকলেও আমাদের দেশে ভারতীয় চ্যানেলের রমরমা সম্প্রচার চলছে। এতে হিন্দি চ্যানেলের চাহিদা-কদরই সর্বাধিক। ঢাকায় মাত্র ক’টি ভারতীয় বাংলা চ্যানেল রয়েছে। অথচ ক’দিন আগে রাজশাহী গিয়ে সাত-আটটি ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখে এসেছি। এই বিভাজনের কারণটি জানা সম্ভব হয়নি।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠান জি বাংলা ‘সারেগামাপা’ নামক গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। ভারতে জি টিভির অগণিত চ্যানেল। অনেক হিন্দির পাশাপাশি ভারতের সব প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষাগুলোর একাধিক চ্যানেল রয়েছে। জি বাংলায় সম্প্রচারিত ‘সারেগামাপা’ রিয়েলিটি শোটি আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে বাংলা চ্যানেলের গানের প্রতিযোগিতায় নব্বই শতাংশ গানই হিন্দি ভাষার। এমন কি বিচারকদের অনেকে হিন্দিভাষী। তাই বাংলা চ্যানেলে হিন্দির মিশেল প্রায় দেখা যায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অনুষঙ্গরূপে। যেহেতু চ্যানেলের মালিকানা হিন্দিভাষী পুঁজিপতি শ্রেণির। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারসহ হরেক বাংলা টিভির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা মাতৃভাষার পাশাপাশি হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন। যেন তারা বাঙালি নন। বাংলা ভাষা প্রান্তিকজনের ভাষা। অথচ কথা বলছেন বাংলা চ্যানেলে এবং বাঙালি দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশেই।

বাংলা ভাষা ভারতের অপরাপর প্রাদেশিক ভাষার সমমর্যাদায় আঞ্চলিক ভাষারূপে স্বীকৃত। হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষা। তবে হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা। ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণি এবং ক্ষমতার বলয়ে থাকা শাসকশ্রেণি এককেন্দ্রিক শাসনের বৃত্তে বৃহৎ ভারতকে কেন্দ্র করে পুঁজিপতিদের বিশাল বাজার সৃষ্টি করেছে, পরাধীন আমল থেকে আজ অবধি। মাতৃভাষাভিত্তিক জাতীয়তা থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক উপায়ে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্যÑতামিলনাড়ু, কেরালা, অল্প্রব্দ, কর্ণাটক ব্যতিক্রম। চার রাজ্যের পৃথক চার ভাষা তামিল, মালায়ালম, তেলেগু, কানাড়া পরিত্যাগ করে তারা হিন্দির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়নি। বরং হিন্দির অনুপ্রবেশ তারা কঠোরভাবে রুখে দিয়েছে। দক্ষিণের ওই চার জাতি নিজেদের মাতৃভাষার বিকল্প ভাষারূপে সরকারি ভাষা হিন্দিকে নয়, ইংরেজিকে বেছে নিয়েছে। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় হিন্দি ভাষাকে মাধ্যমরূপে অবলম্বন করা হয়েছে ভারতব্যাপী বাণিজ্যের অভিপ্রায়ে। মাড়োয়ারি, পার্সি পুঁজিপতিদের ভাষাও হিন্দি। তাই হিন্দির দাপটে ভারতের স্বীকৃত আঞ্চলিক সব ভাষার চিড়ে চ্যাপ্টা দশা। আমরা মাতৃভাষার জন্য ত্যাগ-আত্মত্যাগ করা গর্বিত জাতি। তবে স্বীকার করতে হবে রাষ্ট্রভাষা সর্বস্তরে চালু করা সম্ভব হয়নি। আমাদের শিক্ষাক্রম তিন পৃথক ভাষায় বিভক্ত-বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি। এতে আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রকৃত ছবিটি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। পুঁজিবাদের অবাধ অনুপ্রবেশে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে একে একে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তেমনি সমাজে সমতার সব সম্ভাবনাও। কিন্তু পুঁজিবাদ আমাদের সব সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে সমাজে শোষণ, বৈষম্যকে শক্ত-পোক্ত করে তুলেছে। বৈষম্যের ছায়া ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে-নিশ্চয় এটা বড় দুর্ভাবনার বিষয়। এই ছায়া সরাতেই হবে। আমরা চাই সাইমোর পরিধি বাড়তে থাকুক। পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বিজাতীয় সংস্কৃতির অভিমুখে।


লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ‘নতুন দিগন্ত’


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা