সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:১৪ এএম
‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায়/ দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না/ ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি বাঁয়ের দিকে পুকুরঘাট/ সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না।’ দেশের খ্যাতনামা ব্যান্ড ‘দলছুট’-এর সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পা মজুমদারের কণ্ঠে গীত জনপ্রিয় ও বহুলশ্রুত এই গানটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ৫ সেপ্টেম্বর “চেয়ারের ‘নেশা’ তারে ছাড়ে না” শিরোনামের প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি একেএম ফজলুল্লাহর অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে প্রশ্ন জাগে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা কী করে স্বপদে বহাল আছেন? তিনি বিগত সরকারের বদান্যতায় দফায় দফায় আটবার মেয়াদ বাড়িয়েও আবার বৃদ্ধির স্বপ্নে নিমগ্ন। প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতি, নিজের মেয়ের প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি করে অনেক নিকট আত্মীয়কে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়াসহ বিস্তর অভিযোগে অভিযুক্ত ফজলুল্লাহর খুঁটির জোর কোথায়- এ প্রশ্নটি সঙ্গত কারণেই জাগে।
দেশের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াসা। কারণ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা তাদের অন্যতম দায়িত্ব। পানির অপর নাম জীবন, তা আমরা জানি। পাশাপাশি এও জানি, এই পানিই আবার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির গুণগত মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি দুর্নীতিবাজ এমডি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পদত্যাগের চাপে পড়েও এর বিপরীতে তার আমলের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে তিনি যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাতে বিস্ময় জাগে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এখনও নগরবাসী যথাযথভাবে পানি না পাওয়ার বিস্তর অভিযোগ আছে। ৪ সেপ্টেম্বর এমডির পদত্যাগের দাবিতে চট্টগ্রামে আন্দোলন করেছে বৈষম্যবিরোধী সাধারণ নাগরিক সমাজ। বিগত ১৫ বছরে তার বিরুদ্ধে এমন কর্মসূচি আরও পালিত হলেও তিনি স্বপদে রয়েছেন অদৃশ্য খুঁটির জোরে। গ্রাহকরা তুষ্ট না হলেও এমডি ফজলুল্লাহ ওই পানির মধ্যে কী মধু পেয়েছেন তার কীর্তিকলাপ এই প্রশ্নও দাঁড় করায়। দেশে যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ এগিয়ে চলেছে, তখনও চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি উচ্চকণ্ঠে বলছেন, আরও পাঁচ বছর তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন! অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দুই নেতাকে তিনি ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের অনেকের অভিযোগ, বিগত ১৫ বছরে এমডি ফজলুল্লাহর দুষ্কর্মের খতিয়ান কত বিস্তৃত, তদন্ত করলেই তা উঠে আসবে। নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি উত্থাপিত বহুবিধ দুষ্কর্মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে আত্মকথন শুনিয়েছেন, তাও নির্লজ্জতার সাক্ষ্য বহন করে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহ ১৯৯৮ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে অবসরে যান। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান হিসেবে এক বছরের নিয়োগ পান। এরপর থেকেই তৎকালীন সরকারের ‘বিশ্বস্ত’ হিসেবে গত ১৫ বছরে আটবার চুক্তি বাড়িয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে বহাল রয়েছেন! আমরা তার অনাচার-অনিয়মের তথ্যে বিস্মিত যুগপৎ ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি না। সংবাদমাধ্যমে তিনি তার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার সংবাদ শিরোনাম হলেও কোন ‘জাদুর কাঠি’র স্পর্শে তিনি তুঘলকি কাণ্ড চালিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। প্রশ্ন উঠেছে, বিগত সরকারের সময়ে প্রভাবশালী ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের আশীর্বাদের স্পর্শিত হাতে দুষ্কর্ম চালানোর পথ সুগম করলেও এখন তিনি কোন ছত্রছায়ায় অনিয়ম-অনাচারের পাশাপাশি আরও পাঁচ বছর মেয়াদ বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছেন? স্বাভাবিক কারণেই জনপরিসরে আরও প্রশ্ন উঠেছে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও কি এই দুষ্কর্মকারী বহাল তবিয়তেই থাকবেন?
সেবা সংস্থাগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। চুক্তির মেয়াদ একসঙ্গে তিন-চার বছরের হলেও মেয়াদান্তে তা বাড়ানোর অবকাশ থাকায় অনেকেরই যুগ পার করেও বহাল তবিয়তে দায়িত্বে থাকার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও প্রশ্নবোধক। এই অপচর্চা অব্যাহত থাকার ফলে দুর্নীতিবাজদের আস্ফালন সহ্য করেছে সাধারণ মানুষ। আমরা প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেই প্রত্যক্ষ করেছি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধারাবাহিক অপসংস্কৃতির ফলে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হলেও চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধিকারীদের ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করার ফলে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের ক্ষতির চিত্র স্ফীত হয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ৮০ ঊর্ধ্ব বয়সি চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহ বয়সের ভার সয়েও দাপটে চালিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতা। তাকে নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ না থাকলেও তিনি তাতে মোটেও বিব্রত নন।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে ২০২২ সালের মে মাসে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই নির্দেশনা আসার পরও তিনিসহ আরও চার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের নামে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যা্ন। কখনও প্রশিক্ষণ, কখনও পরিদর্শনের কাজে বিদেশ সফর করেন বহুবার! শুধু তাই নয়, নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে প্রতি্ষ্ঠানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও তিনি অবাধ দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ফায়দা লোটার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে কম নয়। বিগত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম ওয়াসা পানির সংকট কাটাতে পারেনি, উল্টো এর মান নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে। দফায় দফায় বাড়ানো্ হয়েছে পানির দাম। চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহর স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও অপচয়ের একেকটি অধ্যায় যেন রূপকথার গল্প। আমাদের স্মরণে আছে, ২০২২ সালে দুদকের অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘কোটিপতি’ গাড়িচালকের সন্ধান মিলেছিল। এসব কিছুর উৎসই এমডির অনিয়ম-দুর্নীতি।
আমরা জানি, বিগত সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার বারবার ব্যক্ত করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই অঙ্গীকার ছিল উচ্চারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারীদের অনেকেই এ কারণেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। ‘হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে’Ñ এমন আত্মঘাতী চিন্তা থেকে নীতিনির্ধারকরা বের হয়ে আসতে পারেননি। কারণ তাদের অনেকেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন দুর্নীতিতে। আমরা চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির দুষ্কর্মের যথাযথ প্রতিবিধানের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে বছরের পর বছর তার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাই এবং দেখতে চাই এর যথাযথ প্রতিবিধান। দারিদ্র্য-দুর্নীতি ও সামাজিক দুষ্টচক্রের কথা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের দাবি, চট্টগ্রাম ওয়াসায় দুর্নীতির ‘হাটবাজার’ যার কারণে ক্রমবিস্তৃত হয়েছে, সেই এমডি যেন কোনোভাবেই অনুকম্পা না পান।