রাষ্ট্রচিন্তা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৮ এএম
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমরা যে বাস্তবতার
মধ্যে আছি তা উপলব্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। কয়েকদিন হলো দীর্ঘদিনে স্বৈরাচারের যে চিত্র
তুলে ধরা হয়েছে তা আমাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতার মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি যা ঘটেছে
তাকে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব? কেউ বলছেন বিপ্লব, কারো কাছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। আমার
ধারণা, এর কোনোটিই সত্য নয়। বরং আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী
সরকারের পতন ঘটেছে। এই পতন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই করা সম্ভব ছিল। অন্তত তাতে দেশে এত
রক্তপাত হতো না। এমন বিপ্লব ঘটত না। তা হয়নি বিধায় রাজপথে জনগণ নেমে আসে। জনগণের প্রবল
প্রতিরোধেই স্বৈরাচারের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়েছে এবং তাদের পতন ঘটেছে। সরকারের পতনের
পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তাই আমাদের সামাজিক বিপ্লব ঘটেছে এ কথা
পুরোপুরি বলা যাবে না। কিন্তু এই সমাজের মধ্যে এখনও বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
আমরা জানি, জুলাই
মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে
ওই আন্দোলন দমনের জন্য ফ্যাসিবাদী সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে। আস্তে আস্তে ওই আন্দোলনে
শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো একটি মঞ্চ গড়ে তোলে। সরকার
পতনের ওই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের একার মাধ্যমেই সম্ভব হয়নি। মেহনতি খেটে খাওয়া
মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। অসংখ্য তরুণ সাহসিকতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
দাঁড়িয়েছে। রেহাই পায়নি শিশুরাও। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে রাজপথে
নামিয়েছে। এই বৈষম্য শুধু চাকরিক্ষেত্রের বৈষম্য নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্যই ছিল আসল বৈষম্য।
এ ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য সামাজিক পর্যায়ে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ
সামাজিক বিপ্লবের অপেক্ষা করছে। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যে রাষ্ট্র পেয়েছি এই রাষ্ট্রেই
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সব রূপ বিগত পনেরো বছর দেখা গেছে। এমন নিকৃষ্ট রূপ আমরা অতীতে
কোনোদিন দেখিনি। কাজেই সামাজিক বিপ্লব ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় জমিদার ও প্রজাদের
মধ্যকার সম্পর্ক নানা সময়ে পুনর্গঠিত হয়েছে। এই পুনর্গঠনের বাইরে নই আমরাও। তবে এখনও
মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেছে।
সামাজিক বিপ্লবের
এই আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে এখনও বাস করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সামাজিক বিপ্লবের
জন্য বিক্ষোভ এবং শেষ পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলনও হয়েছে। বামপন্থিরা যদি সে রাজনীতিতে
নেতৃত্ব দিতেন তাহলে তা করা কঠিন কিছু ছিল না। ১৯৪৭ সালে বিশেষ করে বাংলায় প্রায় বিপ্লবী
পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সেই বিপ্লবী পরিস্থিতির সুযোগ বামপন্থিরা নিতে পারেননি। তারা
এই নেতৃত্ব নিতে পারেননি বিধায় দেশভাগ হয়েছে। দেশভাগ আমাদের জন্য কত বড় সর্বনাশ তা
আজ আর ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে দেশভাগ আমাদের জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছিল
তা আজ আমরা সবাই কমবেশি জানি। ওই সময়ে বিপ্লবের সুযোগটিকে বামপন্থিরা ধরতে পারেননি।
তারপরেও কিন্তু সুযোগ হারায়নি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হলো, তারপর এলো একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের
মূল শক্তিই ছিল সাধারণ মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক
চেতনাই ছিল বেশি। সমাজতন্ত্রীরা দেশের ভেতর থেকে লড়াই করেছেন। আমরা দেখেছি, জাতীয়তাবাদী
নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন তাদের অধিকাংশই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরেও
দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুযোগ ছিল। তেমন পরিস্থিতি আমাদের সামনেই উপস্থিত ছিল।
কিন্তু দুঃখজনক, বামপন্থিরা সে সুযোগ নিতে পারেননি। ১৬ ডিসেম্বরের পরের মুহূর্তকে যদি
বামপন্থি ও সমাজপন্থিরা নেতৃত্ব দিইয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতেন তাহলে তারা সামাজিক বিপ্লব
সংঘটিত করতে পারেতন। আমাদের পরবর্তী ইতিহাস হতো অন্য রকম। ২০২৪ সালে আবারও আমাদের সামনে
একটি সুযোগ এলো। বাংলাদেশে সামাজিক বিপ্লবের যে সময় ফুরিয়ে যায়নি তা আবারও প্রমাণিত
হয়েছে। আমাদের এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবং সম্ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে বিকশিত করার
সুযোগটিকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এক ধরনের সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে। সামাজিক বিপ্লব
ঘটানোর জন্য আমাদের ঐক্য দরকার। ঐক্যই কেবল পারে সমষ্টির জন্য সুফল বয়ে আনতে
পারে এবং তা-ই প্রমাণিত হলো বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। যে বামপন্থি
শক্তি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, যারা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়নের
শিকার তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মৌলবাদীদের কার্যকলাপের পথ রুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ
হওয়া দরকার। হেফাজত কিংবা জামায়াতে ইসলামী ওরা কেউই দেশ-জাতির মিত্র নয়। সুস্থ ধারার
রাজনৈতিক চর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে হবে। ক্রান্তিকালে এই কথাগুলো
গুরুত্ব সহকারে আমলে রেখে আমাদের এগোতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক
ঐক্যকে সুষ্ঠু নেতৃত্বের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করার বিষয় নিয়ে
ভাবতে হবে।
ব্যক্তিমালিকানা
নয়, সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের মধ্যে
এই সামাজিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। মালিকানা যদি সামাজিক না হয় তাহলে
রাষ্ট্রীয় সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। আজ দেশে যে ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে তা পুঁজিবাদী
রাষ্ট্রের বা পুঁজিপতিদের সৃষ্ট সংকট। যারা শাসক তারাও ওই পুঁজিবাদের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
যাদের পতন ঘটেছে তারাও পুঁজিবাদী শক্তির দিকেই মনোযোগ দিয়েছে। এমনকি এখন যারা ক্ষমতায়
থেকে রাষ্ট্র বির্নিমানের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারাও ওই একই পথের পথিক। এ ধরনের রাজনৈতিক
শক্তি যে উন্নতিই করুক তা পুঁজিবাদী উন্নতিই হবে। এ ধরনের উন্নতি বৈষম্য সৃষ্টি করবে।
এ ধরনের উন্নতি বেকারত্বের হার বাড়াবে। শুধু তাই নয়, এ ধরনের উন্নতি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি
করবে। বৈষম্য, বেকারত্ব ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী উন্নতি আইয়ুব খান পাকিস্তান আমলে
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ক্ষেত্রেও এমনটি প্রযোজ্য। গণতন্ত্রবিরোধী
এ ধরনের উন্নতির বিরুদ্ধে মানুষ বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করেছে।
বামপন্থি সমাজপরিবর্তনকামী
শক্তিগুলোকে তাই এখন দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের একত্রিত হওয়া জরুরি। ১৯৫৪ সালে আমরা যুক্তফ্রন্ট
দেখেছি। যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টরাই বেশি উদ্যোগী ছিলেন। তখন বামপন্থি
শক্তি ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো একত্রিত হলেও আমরা সামাজিক পরিবর্তন দেখতে পেতাম। যুক্তফ্রন্ট
এগিয়ে গেলে আমাদের সমাজ সামাজিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে পারত। আজ সমাজতন্ত্রী, পরিবর্তনকারী
ও বৈষম্যবিরোধী শক্তিদের যুক্তফ্রন্ট গঠন করা জরুরি। এজন্য আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে।
প্রতিটি আওয়াজই আমাদের জন্য অনেক জরুরি। এ-রকম একটা আওয়াজ আমার খুব প্রিয়। আমি মনে
করি, এমন একটা আওয়াজ যা সত্যিই আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো দরকার তা প্রথম
তুলেছিলেন মওলানা ভাসানী। তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে
না’। এমন আওয়াজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিদার। ইনকিলাবের কথা আজ আর আমরা বলতে পারব
না।
ওই আওয়াজ অন্যরা
নিয়ে গেছে। আজ আমি মনে করি, এই নতুন আওয়াজ আমাদের তুলে ধরা দরকার। বৈষম্যবিরোধী সেই
যুক্তফ্রন্ট গঠন করা অনেক জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মতামত। এই যুক্তফ্রন্ট
নির্বাচনেও অংশ নিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছিল, সংস্কারের
পর একটি সুষ্ঠু-স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করাই তাদের লক্ষ্য। তাদের এই নির্বাচনের দুটো
লক্ষ্য থাকবে। প্রথমটি, সংবিধান তৈরি করা। নির্বাচিত প্রার্থীরা গণতান্ত্রিক পন্থায়
পুরাতন সংবিধানের অসংগতি দূর করে নতুন সংবিধান গড়বেন। এই লক্ষ্যেই এ যুক্তফ্রন্ট অংশগ্রহণ
করতে পারে। ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়েও আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে। বর্তমানে যে ধরনের
নির্বাচনী কাঠামো রয়েছে তেমনটি আমরা চাই না। বরং আমরা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি
করি।
সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের পুঁজিবাদী নেতৃত্ব দেখেছে। ফলে দেশ পরিচালনার শক্তি নিয়ে মানুষের নতুন আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপির প্রতিও তাদের আর আস্থা নেই। আওয়ামী লীগ না থাকলেও কারা ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে শূন্যতা সৃষ্টি হোক তেমনটিও আমরা চাই না। এই শূন্যতায় মৌলবাদীরা দখল নেবে তা সুস্পষ্ট। মৌলবাদীদের পক্ষে পক্ষপাত নানাভাবেই আমাদের সামনে দেখা দিচ্ছে। আর এই মৌলবাদীদের রুখে দেওয়ার জন্যই সব বামপন্থিকে রুখে দেওয়া জরুরি। ইতোমধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই ঐক্যকে আমরা অভিনন্দন জানাই। কাব্যিক এই ঐক্য প্রতিফলিত হওয়া জরুরি সমাজের সব স্তরে। সব স্তরের মানুষের কাছে যেন এ বার্তা যায় এবং ঐক্য গড়ে ওঠে। সব স্তরের মানুষ থেকে প্রতিনিধিত্ব বের করে আনা দরকার এবং এর প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই। এ প্রতিফলন ঘটতে হবে রাজনীতিতে। রাজনৈতিক প্রতিফলনই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।