ফিলিস্তিনে গণহত্যা
লুবনা মাসারওয়া
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৪ এএম
লুবনা মাসারওয়া
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে
অনেকটাই এগিয়ে কমলা হ্যারিস। গাজা যুদ্ধ বন্ধে তার বক্তব্য দ্বান্দ্বিক অবস্থানে। কারণ
তিনি ইসরায়েলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। এই সমর্থনকে তিনি যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের
চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার বক্তব্য পুরোনো রেকর্ডই। তার উত্তরসূরিরা যেভাবে চিন্তা
করেছেন তিনিও সেভাবেই করেছেন। গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে
বললে অত্যুক্তি হবে না। গাজায় প্রতিটা দিন দুর্বিষহ। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও লাশ মিলছে।
কারো মাথা ফাটা, শিশুরা আহত, কেউ নিখোঁজ। ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক এই অত্যাচার দীর্ঘদিন
চলছে। বিশেষত, গত ১১ মাসে তার ব্যাপ্তি আরও বেড়েছে। মৃতের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। পশ্চিমা
সম্প্রদায় এ যুদ্ধ বন্ধে নানা আলাপ দিলেও তা কার্যত ফাঁপা বুলি। গাজায় এখন সাংবাদিকতার
পরিবেশও নানাভাবে বিঘ্নিত। পশ্চিমা সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, গণহত্যার সময় কোনো ভূখণ্ডে
রেড জোন থাকতে পারে না।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বিপ্লব অনেক সৃজনশীল।
তাদের ভাবনার জগৎ ও আলোড়ন আমাদের আবেগতাড়িত করে। ফিলিস্তিনি বিপ্লবকামী সংগঠন ফাতাহ
নিজেও স্বীকার করেছে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের ভূখণ্ডের অধিকার ধরে রাখতে।
কিন্তু ইসরায়েল জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের আটক করে
চলেছে। ইসরায়েলের কারাগারে তাদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রাও অতীতের তুলনায় বেড়েছে।
একজন সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি দৃষ্টিকটু ও ভয়াবহ মনে হয়। গাজায় পশ্চিমা সাংবাদিকরাও
নিরাপদ এমনটি বলা যাবে না। বরং সাংবাদিকতার পথও তারা রুদ্ধ করে দিয়েছে। জঙ্গিবিরোধী
অভিযানের নামে তারা যেভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন এমনকি নৈতিকতা বিরোধী।
ইতোমধ্যে গাজা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে
আলোচনা হলেও কার্যত তা এগোয়নি। পশ্চিমা সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, গণহত্যাকে লাল সীমানা
বা ভৌগোলিক মানচিত্রের দাগে তারা খণ্ডিত করতে পারেন না।
দেড় দশক ধরে আমি অনেক বৈঠক ও
কনফারেন্সে অংশ নিয়েছি এবং পশ্চিমা সরকার, থিংকট্যাংক ও একাডেমিয়ার অনেক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি,
যারা বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী
শাসনের উত্থানে উদ্বিগ্ন। তাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন,
কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা উদার
বিশ্বব্যবস্থা এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। তবে আমি
ভিন্নমত পোষণ করি। আমি মনে করি, উদার বিশ্বব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি উদার গণতন্ত্র থেকেই আনছে;
তাদের স্বৈরাচারী নেমেসিস থেকে
নয়। কারণ পশ্চিমা সরকারগুলো যেসব মূল্যবোধ সুরক্ষার কথা বলে আর বাস্তবে তারা যা
করে, এর মধ্যে রয়েছে বিস্তর
ফারাক। ফলে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হয়েছে, যা উদার বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমরা আমাদের মূল্যবোধ নিয়ে কী
বলি এবং আমাদের বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্যগুলো কীভাবে তুলে ধরি,
তা গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ
হলো, আমরা পরে বা বাস্তবে কী
করি? মানুষের চোখ-কান আছে।
তারা যখন বাস্তবতার বিপরীতটা দেখে তখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ইসরায়েল ও
ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বয়ান ও কর্মকাণ্ডে এমনটাই ঘটছে। অবশ্য তাদের বলা ও
করার মধ্যে এই অমিল নতুন নয়। পশ্চিমা উদার ব্যবস্থা তাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুত
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। তারা বিশৃঙ্খলা, রক্তপাত এবং ‘গণতন্ত্রায়ন’ ও ‘মুক্তির’ ফাঁপা প্রতিশ্রুতির
ধ্বংসাবশেষ রেখে গেছে। এতে ‘অন্যরা’ পশ্চিমা বয়ান এবং এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে
শুরু করে। যুদ্ধগুলো এমন ধ্বংসাত্মক হয় যে, পরবর্তী সংগ্রাম হয় ব্যাপক এবং ‘পুনর্গঠন’ তহবিল শেষ হওয়ার
অনেক পরে তা মিডিয়ায় আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ এবং আবেগপূর্ণ পোস্ট করা হয়। ওই সময় বিশ্বের সামষ্টিক বিবেক আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধ-পরবর্তী
ধাক্কা এ অঞ্চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে।
পশ্চিমারা মানবাধিকার এবং
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারের কথা বলে; একই সঙ্গে ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করে
এবং যত-ইচ্ছা-তত ফিলিস্তিনি হত্যার মিশনকে দায়মুক্তি দেয়। এ কারণেই ইসরায়েল
‘আত্মরক্ষার’ নামে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে দিব্যি হত্যা করার ধৃষ্টতা
দেখাচ্ছে, যার
মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এর মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের বহুপাক্ষিকতাবাদের
মূল্যবোধ ও নীতির বিপরীত আচরণ করছে। জাতিসংঘ যেসব মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত,
তারা সেগুলোর বিরুদ্ধেও
যাচ্ছে।
পশ্চিমাদের মানবাধিকার
সুরক্ষায় অনেক ভূমিকা আছে। কিন্তু এও বোঝা
জরুরি, পশ্চিমাবিশ্ব
তার নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে এই নীতিগুলোর প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা দেখায়। বৈশ্বিক
নেতৃত্ব বা ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ধরে রাখার বিষয়ে
উদ্বিগ্ন যে কেউ অবশ্য জিজ্ঞাসা করবেন, কেন দেশটি বিশ্বমঞ্চে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছে? কেন
যুক্তরাষ্ট্র এত উচ্চ কূটনৈতিক মূল্য দিতে ইচ্ছুক? ওয়াশিংটনের এই অবস্থান কেবল বিশ্বস্ত বিশ্বশক্তি হিসেবে
নিজের অবস্থানই ক্ষুণ্ন করবে না, বরং ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে তার ক্ষমতাকেও ধ্বংস করবে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বৈশ্বিক
খ্যাতি রক্ষা করতে চায়, তাহলে প্রথমে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে
বাধা দেওয়া বন্ধ করা উচিত। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি এবং ইসরায়েলি বসতির
নিন্দা– এ দুটি যুক্তরাষ্ট্রেরই নির্দেশিত নীতির অংশ। এসব ব্যাপারে সাধারণ পরিষদের
প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা করতে পারে না। তাকে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর আবেদনে
সাড়া দিতে হবে এবং সেগুলোর কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ানো চলবে না। যারা গাজা
সংকটের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘকে ব্যর্থ বলছে, তারা আসলে ভুল। গাজায় যা ঘটছে,
জাতিসংঘ দ্ব্যর্থহীনভাবে সব
রিপোর্ট করে চলেছে এবং বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপেরও আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের সম্মিলিত
বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, এর মহাসচিব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান,
ইউনিসেফের প্রধান– সবাই
সহিংসতা বন্ধে বিশ্বকে পদক্ষেপ নিতে অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব? বাস্তবে
কার্যকর ভূমিকাই নিতে পারেনি।
মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন