স্মরণ
ইমদাদুল হক
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩০ এএম
কামরুল ইসলাম সিদ্দিক
কামরুল ইসলাম
সিদ্দিক ছিলেন প্রকৌশলী এবং নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ। তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল
অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামোর
রূপকার হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের
আজ ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের
স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন।
বিদ্যুৎ, পানিসহ
বহু খাতেই বিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। রাবার ড্যাম দিয়ে কৃষির পানি ধরে রাখার লক্ষ্যে প্রলয়ঙ্করী
বন্যা ঠেকানোর প্রকৌশলী ধারণা ছিল তারই প্রকৌশলজ্ঞানের স্বাক্ষর। ‘জিআইএস’ ও ‘জিপিএস’
বিপ্লবের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘ডিজিটাল ম্যাপিং’। আজকের মেট্রোরেল,
এক্সপ্রেসওয়ে ছিল তারই নকশাকৃত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিবি) কৌশলগত পরিবহন
পরিকল্পনায় (এসটিপি)। কিন্তু তিনি ব্যক্তিবন্দনার ব্রাকেটবন্দি ছিলেন না। দলীয় ও অংশগ্রহণমূলক
উদ্যোগের জনপ্রিয় উদ্যোক্তা ‘কিউআইএস’ হিসেবেই ছিলেন সমধিক পরিচিত। ছিলেন নিভৃতচারী
ব্যতিক্রমী সরকারি আমলা। কর্মীদের কাছে ‘বড় স্যার’ হয়েও আমৃত্যু খেটেছেন কামলার মতো।
পুরো জীবনটাই বরবাদ করেছেন দেশের উন্নয়ন প্রকৌশল জ্ঞান প্রয়োগে। তিনি কেবল স্বপ্নদ্রষ্টাই
ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগরও।
সে কারণেই দেশে
বোর্ড অব অ্যাক্রিডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশনের বিকাশে ইঞ্জিনিয়ার্স
ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ-আইইবিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেশের প্রকৌশল খাতে অনুকরণীয়
ব্যক্তিত্বে পরিণত হন জীবদ্দশাতেই। নানা সরকারের সময় নিজ অবস্থানে অনড় থেকেছেন। ঋজু
ছিলেন, নত হননি, তেলবাজিও করেননি। ভালোবেসে এগিয়ে গেছেন দুর্গম পথ। কঠিনেরে করেছেন
কোমল।
স্বৈরশাসক, তত্ত্বাবধায়ক
এমনকি গণতান্ত্রিক প্রতিটি সরকারই তার কাজে মুগ্ধ ছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয়
সম্মাননা থেকে বঞ্চিতই থেকেছেন। বিশ্বব্যাংক তাকে ‘ম্যাজিক বয়’ খেতাব দিলেও জাতীয় কোনো
পদকে ভূষিত হননি। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায়।
বাবা নূরুল ইসলাম সিদ্দিক এবং মা বেগম হামিদা সিদ্দিক। এ দম্পতির তিনি দ্বিতীয় সন্তান।
পড়ালেখার শুরু কুষ্টিয়ায়। এখান থেকেই প্রাথমিক ও ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯৬২ সালে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন কুষ্টিয়া কলেজ থেকে। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান
প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর
ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের
ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বব্যাংক কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে ১৯৯৯ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল
রোড ফেডারেশন’ কর্তৃক বর্ষসেরা ব্যক্তি ঘোষণা করে।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ
শুরু হলে জীবন গড়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক হাতে তুলে নেন অস্ত্র।
নয় মাস সম্মুখসমরে যুদ্ধ শেষে মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে শুরু করেন দেশ গড়ার
সংগ্রাম। এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের রূপকার
হলেও বিদ্যুৎ, পানিসহ বহু খাতেই তিনি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার দর্শন ছিল দেশজুড়ে ভারসাম্যপূর্ণ
উন্নয়ন। তিনি গ্রামের সঙ্গে শহরের দূরত্ব ও নাগরিক সুবিধায় বৈষম্য ঘোচাতে বহু রাস্তা,
কালভার্ট, ব্রিজ বানিয়েছেন। গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সেচ ও বন্যা
ব্যবস্থাপনা নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধত্তোর
বিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামোর পুনর্গঠন ও নির্মাণের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক
অবস্থার পরিবর্তনে অভূতপূর্ব মেধা ও অনন্য দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন। এ কর্মবীরের
স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।