অন্তর্বর্তী সরকার
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৩৬ পিএম
প্রবল গণআন্দোলন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের পতনের পর রাতারাতি সব অনিয়ম এবং সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়-এ নিয়ে দেশে এ মুহূর্তে একটি শক্ত ধরনের জনমত গড়ে উঠছে। বিশেষ করে ২৫ আগস্ট আনসার বিদ্রোহ কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সচিবালয়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল, তা খুবই দুঃখজনক। সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এত দিন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে এলেও দাবি আদায়ের জন্য তারা যে পন্থা বেছে নিলে, সময়ের বিবেচনায় তা কেবল অযৌক্তিক নয়, অমানবিকও বটে। দেশের একটি বড় সংখ্যার মানুষ এ মুহূর্তে ভয়াবহ বন্যার সঙ্গে লড়ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাদের বেতনের একটি অংশসহ নানাভাবে বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন। বাদ যাচ্ছেন না কেউ। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সাধ্যমতো শ্রম দিয়ে যাচ্ছে, অর্থ এবং ত্রাণ জোগাড়ের কাজ করে যাচ্ছে। অভাবনীয় মানবতার জাগরণ।
এ সবকিছুই যখন একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের ভেতরের মানবিক সত্তা জাগিয়ে তুলছে, আমাদের তৃপ্ত করছে, কষ্টে থাকা মানুষের সঙ্গে কষ্ট ভাগাভাগির সুযোগ সৃষ্টি করছে, এমন সময় আনসার সদস্যদের পক্ষ থেকে দাবি আদায়ের নামে অরাজকতা সৃষ্টি এবং হামলার ঘটনা সংঘটিত করা আমাদের দারুণভাবে হতাশ করেছে। সেই সঙ্গে তাদের পেশকৃত দাবির যৌক্তিকতাও এর মধ্য দিয়ে তারা প্রশ্নের মুখে ফেলল। এহেন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ছাত্রসমাজের ওপর হামলা এবং সরকারের উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ করে রাখার দায়ে ইতোমধ্যে প্রেপ্তার হয়েছে কয়েক শ আনসার সদস্য। খারাপ লাগলেও আইন আইনের মতো চলুক এটাই প্রত্যাশা থাকবে, তার পরও আইনের মধ্যে যদি তাদের প্রতি কোনো সহনশীলতা প্রদর্শনের সুযোগ থাকে সেটাও বিবেচিত হবেÑএমন আশাবাদ রইল।
এর বাইরেও দাবি আদায়ের নামে সরব হয়েছেন সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিতসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এদের সবার একটাই কথাÑবিগত সরকারের সময় নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তারা। এ সরকার যেহেতু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত, সে বিবেচনায় এ কয়েক দিনের মধ্যেই দাবির পর দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকে এসব দাবির অনেকটির মধ্যে কিছু কিছু উস্কানির কথা বলছেন, বিশেষ করে বিগত সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আসছে। তবে বিষয়টির সত্যাসত্য যাচাই করার আগেই বলে দেওয়া যায় যে, এতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা এবং সমর্থনের কোনোটাই থাকার সুযোগ নেই, বরং মানুষের মধ্যে এ সবকিছু ব্যাপক বিরক্তির উদ্রেক করছে। এর মূল কারণ একটাই, আর তা হলো একটি দীর্ঘ সময়ের সরকারের পতনের পর সবে একটি নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করল।
সারা দেশের মানুষের সব প্রত্যাশা নতুন সরকার কতটুকু ধারণ করতে পেরেছে এবং সে অনুযায়ী কতটুকু যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছে, তা বুঝতে হলে সরকারকে আগে সবকিছু বুঝে নিতে হবে। আর এ সময়টা এখনও আসেনি। আর এরই মধ্যে এত দাবিদাওয়া আদায় করতে চাপ দেওয়া প্রকারান্তরে একটি নতুন সরকারের জন্য সুষ্ঠু কাজের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। পেশকৃত প্রতিটি দাবির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি অনেক দিন ধরে ভালো না। একটি দুর্বল অর্থনৈতিক শাসন থেকে টেনে এনে গতি ফেরানো খুবই চ্যালেঞ্জিং। এহেন অবস্থায় দেশের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া সমস্যা উত্তরণে সরকারের একার পক্ষে কিছু করার থাকবে না।
দেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২৫ আগস্ট সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অনেক কিছুই বলেছেন। তার ভাষণের মধ্যে যেমন ছিল সরকারের দিক থেকে নানাবিধ অব্যবস্থাপনা অতিক্রম করে দেশকে টেনে তোলার প্রতিজ্ঞা, একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বিরাজমান নানাবিধ দাবি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হওয়া এবং একইভাবে দাবি আদায়ের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলার বিষয়ে তার বক্তব্যে কিছুটা হতাশার সুর পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত পরিবর্তন ম্লান হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দাবি আদায়ের নামে প্রায় প্রতিদিনই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এবং সচিবালয়ে অবস্থান ও সভাসমাবেশ আয়োজন কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি নিয়ে একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশেপাশে, শহরের বিভন্ন স্থানে সভাসমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখকষ্ট আপনাদের মনে জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এ দুঃখ ঘোচানোর পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধÑআমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আইনসম্মতভাবে যা কিছু করা দরকার, তা অবশ্যই আমরা করব।’
একইভাবে দেশের বিভিন্ন আদালতে আসামিদের উপস্থাপনকালে তাদের উদ্দেশ করে হামলা এবং হেনস্থা নিয়ে সরকার যে বিব্রত, তা-ও তার বক্তব্যে উঠে এসেছে। একজন আসামিকে যখন গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিম্মায় আদালতে উপস্থাপন করা হয়, এমন অবস্থায় তার ওপর হামলা নিঃসন্দেহে দণ্ডনীয় অপরাধ। সাম্প্রতিক সময়ে জনরোষপ্রসূত এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের বিচারব্যবস্থার এখতিয়ারকে প্রশ্ন করার শামিল। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে এভাবেÑ‘বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। তার এ ভাষণে তিনি বিদ্যমান সব সম্ভাবনা, সরকারের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং এসব থেকে উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে সহজসরল ভাষায় তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। এ সরকারের মেয়াদকাল নিয়েও তিনি তার স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে নিজেদের ছাত্রসমাজ কর্তৃক নিয়োগকৃত হিসেবে আখ্যায়িত করে জানিয়ে দেন যে তাদের আহ্বানেই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি এবং তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা তত দিনই থাকবেন যত দিন ছাত্র-জনতা চাইবে। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশের কোনো কোনো পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের যে তাগিদ আসছিল সেটা প্রশমিত হয়ে বরং এমন উপলব্ধির জন্ম হয়েছে যে, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয় নিয়ে দায়িত্ব নেওয়া এ সরকারের দায়িত্বের নির্দিষ্ট সীমারেখা নিয়ে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। বরং সংস্কারের প্রয়োজনে যত দিন প্রয়োজন তত দিনই এ সরকারের দায়িত্বে থাকা দরকার।
এর মধ্য দিয়ে দেশের সচেতন মানুষের মাঝে নতুন করে এ উপলব্ধিবোধের সঞ্চার হয়েছে যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এত দিন পালা করে দেশ শাসন করেছে, নতুন করে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের আরও অনেক কৌশলী, যোগ্য এবং ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে। তবে এখানে নিজেদের অজান্তেই এক ধরনের কষ্ট থেকে যায়, কারণ সরকার একটি রাজনৈতিক সত্তা, যার প্রতিপালন এবং বিকাশ ঘটার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে, অথচ এ রাজনৈতিক দলগুলোকে শুদ্ধ করার দায় এসে পড়েছে আজ দেশের সুশীলসমাজের ওপর। তার পরও সবার একটাই প্রত্যাশাÑভালো থাকুক আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষ।
আজকের আলোচনায় মূলত যে বিষয়গুলো তুলে ধরে বলার চেষ্টা করেছি তার মর্মার্থ হচ্ছে, দীর্ঘ সময় পর জনপ্রত্যাশার একটি সরকার এ মুহূর্তে দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, যাদের রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় নেই। যারা রাজনৈতিক সরকার দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতগুলো মেরামত করে দেশকে আবারও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছেই তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। এত দিনের এত হতাশাকে যদি আমরা ধারণ করতে পারি, তাহলে দেশ এবং মানুষের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থে এ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাওয়াও আমাদের কর্তব্য। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি আমাদের সব স্বপ্নের ভাষা অনুধাবন করে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এ লক্ষ্যেই তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্বদরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদের হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।’ ধৈর্য ধারণ করে এ মুহূর্তে দাবিনামার নামে সরকারকে বিব্রত না করে এ লক্ষ্যে যৌক্তিক সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।