সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪ ০৯:০৫ এএম
ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সাফল্য আসে। যাকে বলা হয়Ñ একতাই বল। সেই ‘দশে মিলে করি কাজ/হারি জিতি নাহি লাজ’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাঁধ মেরামতে এগিয়ে এসেছেন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের মানুষ। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ২৭ আগস্ট প্রকাশিত ‘বাঁধ মেরামতের সংগ্রামে হাজারো মানুষ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২২ আগস্ট দেলুটি ইউনিয়নের কালিনগর এলাকার পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৩ গ্রাম প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধটি উপজেলা প্রশাসন ও পাউবোর তত্ত্বাবধানে দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল ও সোলাদানা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এসএম এনামুল হকের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ মেরামতের চেষ্টা করছেন। প্রথম দুদিন তারা বাঁধের যেটুকু অংশ মেরামত করেছিলেন তা আবারও জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। পরে প্রায় দুই হাজার মানুষ সম্পৃক্ত হয়ে পাঁচ দিন কাজ করে বাঁধের তিন ভাগের দুই ভাগ মেরামত করেছেন।
স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ মেরামতের এ জনউদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।
আমরা দেখেছি, অতীতেও বিভিন্ন সময়ে দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছেন
ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে। তারা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ মেরামতের কাজ শেষ করে
মানুষকে দুর্ভোগের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। যাতে করে রক্ষা পেয়েছে বাঁধের ভেতরে থাকা বাড়িঘর,
গবাদিপশু ও মাঠের ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সবার নৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ
থেকেই পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ বাঁধ মেরামতের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত
করেছেন। সেখানে সবাই স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। স্বতঃস্ফূর্ত তাদের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত
জানাই। বাঁধটি পুরো মেরামত হলে এলাকার তেরোটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ দুর্ভোগের হাত
থেকে রক্ষা পাবেন। শুধু খুলনার পাইকগাছা অঞ্চলের মানুষই নয়, একই ধরনের জনবান্ধব আরও
একটি উদ্যোগের খবর, প্রকাশ পেয়েছে একই দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। ‘ছাত্র-জনতা ও বিজিবির
উদ্যোগে রাস্তা সংস্কার’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নেত্রকোণার দুর্গাপুরে বর্ডার
গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় কাঁচা রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে।
সম্প্রতি ভারী বর্ষণে বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে রাস্তাটি যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
ঝুঁকি নিয়ে চলাচলে দুর্ঘটনাও ঘটছিল। এ অবস্থায় ২৬ আগস্ট উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের
কালিকাপুর বাজার থেকে ভরতপুর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা নেত্রকোণা বিজিবি ব্যাটালিয়নের
(৩১ বিজিবি) ভরতপুর বিওপির বিজিবি সদস্য, স্থানীয় ছাত্র-জনতা ও ইউপি সদস্য জহিরুল হকের
সহযোগিতায় মেরামত করে যান ও জনসাধারণের চলাচলের উপযোগী করা হয়।
অধিকাংশ সময়ই আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ, একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার
সঙ্গে যোগসাজশ রাখা ঠিকাদার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় জনগণকে সরাসরি
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা থেকে বিরত রাখা হয়। জনসাধারণের সরাসরি সম্পৃক্ততা
না থাকায় রাষ্ট্র তথা সরকারের সম্পদ যে প্রকৃতপক্ষে জনগণেরই সম্পদ সে ধারণা তৈরিও বাধাপ্রাপ্ত
হয়। এর কুফল সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর কীভাবে পড়ে তার দুঃখজনক নজির আমরা দেখছি সাম্প্রতিক
সময়ে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর যেভাবে রাষ্ট্রীয় স্থাপনাসহ
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছেÑ তা যেমন নিন্দনীয়,
তেমনি উদ্বেগেরও। অথচ এসব সম্পদের মালিক সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক। অতীতেও
আমরা দেখেছি, বিভিন্ন স্থানে সরকারের উদ্যোগের দেরি হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ নিজ
উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রাস্তা সংস্কার করেছেন। যদি আপদকালীন
মুহূর্তে স্থানীয়দেরই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, তাদেরই সতর্ক থাকতে হয় নিজেদের রক্ষা বাঁধের
সুরক্ষা নিশ্চিতে, তাহলে এলাকাভিত্তিক বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ সকল বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ
ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করা সময়ের দাবি। কেননা, বাস্তবিকভাবেই
প্রমাণিত দেশের অনেক এলাকাতেই ভুক্তভোগীরাই উপকূলীয় বাঁধের ভালো হেফাজতকারী হিসেবে
নিজেদের প্রমাণ করেছেন।
আমরা মনে করি, স্থানীয় সমাজকে যদি উন্নয়নমূলক প্রতিটি কাজে সম্পৃক্ত
করা সম্ভব হয়, স্থানীয় স্থাপনাগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া যায়, তাহলে সামাজিক
সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। স্বেচ্ছাসেবী জনগণকে সরকারি কাজের অংশীদার করার মাধ্যমে
জনসাধারণকে তাদের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সুযোগও তৈরি করে দেওয়া সম্ভব হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড
থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। সমাজসেবামূলক
নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি উন্নয়নমূলক কাজের অংশীজন হিসেবে জনগণের অধিকারের
প্রসঙ্গ উহ্য রাখার সুযোগ নেই।