পরিবেশ-প্রতিবেশ
ড. বিভূতিভূষণ মিত্র
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪ ০৯:০১ এএম
ড. বিভূতিভূষণ মিত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় লিখেছিলেন, দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/লও যত লৌহ লোষ্ট্র
কাষ্ঠ ও প্রস্তর/হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,/দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি’।
বনের ওপর মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই নানাভাবে নির্ভরশীল। ঘর বানানো, জ্বালানি প্রভৃতি
কাজে মানুষ আদি থেকেই বন ব্যবহার করে আসছে। প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্রাবিড় সভ্যতার
বিকাশের সময় বন ব্যবহার সম্পর্কে জানা গেছে। সে সময় তারা গাছ কেটে ঘর বানাত। শিল্পপ্রতিষ্ঠান
গড়ে তুলত। বেদ, পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতেও বন ও বনায়ন সম্পর্কে জানা যায়। এসব গ্রন্থে
শাল, বেল, কিংশুক প্রভৃতির কথা উল্লেখ আছে। সম্রাট অশোক সম্পর্কে জানা যায়, তিনি বন
ও বন্য প্রাণী ভালোবাসতেন ও সেসবের খুব যত্ন নিতেন এবং বন সংরক্ষণ করতেন। মুঘলদের আমলে
বন সংরক্ষণের কথা তেমন পাওয়া না গেলেও তাদের বন ব্যবহার করার কথা জানা গেছে। তারা সৌন্দর্যবর্ধনের
জন্য বনের গাছ ব্যবহার করত। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যাপক মাত্রায় বন কেটে রেললাইনসহ
নানা কাজ শুরু করলেও ভারতবর্ষে প্রথম বন সংরক্ষণের কথা আসে লর্ড ডালহৌসির আমলে। পরে
১৮৬৪ সালের ১ নভেম্বর প্রথম ভারতে বন বিভাগ চালু হয়। বন এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যেখানে
প্রাকৃতিকভাবে গাছপালা, পশুপাখি সবাই মিলে একসঙ্গে থাকে। বনের আয়তন বিশাল হয়ে থাকে
যেখানে নানা বৃক্ষরাজি, ছোটবড় ঝোপঝাড় থাকে। থাকে বিভিন্ন বন্য প্রাণী, পাখি ও কীটপতঙ্গ।
এখানকার ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের মতে
সারা বিশ্বে ১.৬ বিলিয়নের বেশি মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে বনের ওপর নির্ভরশীল। প্রাচীনকাল
থেকে শুরু করে আজ অবধি বিশ্বের ৮০ শতাংশ বন মানুষের কারণে ধ্বংস হয়েছে। এফএওর তথ্য
অনুযায়ী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জ্বালানি কাঠের বার্ষিক অর্থমূল্য ৪ লাখ মার্কিন ডলারের
বেশি। বনের ওপর মানুষ নানাভাবে নির্ভরশীল। বন অক্সিজেন তৈরি করে। আমারেদ ঠান্ডা রাখে।
কার্বন ডাইঅক্সাইড সংরক্ষণ করে। বাতাস পরিষ্কার ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। খাবারের জোগান
এবং কোটি কোটি মানুষকে চাকরি দেয়। বন বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। বাতাস
নির্মল রাখে। পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি লোক বাস করে বনে। এর ৬ কোটিই আদিবাসী। এসব মানুষ
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনের ওপর নির্ভরশীল। একটি তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্রের গাছ বছরে
৮৫০ জন মানুষ বাঁচায় আর স্বাস্থ্য খরচ কমায় ৬৮০ কোটি ডলার। পৃথিবীর ১ কোটি মানুষ সরাসরি
বনের ওপর নির্ভরশীল। বন আমাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধসহ মধু, মাশরুম, ফল, বাদাম ইত্যাদির
জোগানদাতা। এ ছাড়া বনের গাছপালা শব্দপ্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, যা মারাত্মক শব্দদূষণ
থেকে আমাদের রক্ষা করে। বলা হয়, বাড়ির চারপাশে গাছপালা থাকলে ৫ থেকে ১০ ডেসিবেল শব্দ
কমিয়ে আনতে পারে।
বাংলাদেশে পাহাড়ি
বন, ম্যানগ্রোভ বন, উপকূলীয় বন, শালবন, কৃত্রিম বন প্রভৃতি নানা রকম বন দেখা যায়। পাহাড়ি
বন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। বৃহত্তর খুলনায় অবস্থিত
ম্যানগ্রোভ বন। পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ভোলায় উপকূলীয় বন অবস্থিত।
এ ছাড়া বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাংগাইল, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরে শালবন
রয়েছে। পাহাড়ি বনের পরিমাণ ১৩ লাখ হেক্টরের বেশি। এসব বনে তেলশুর, চিকরাশি, বৈলাম,
গামার, বাঁশ, শীল কড়ই প্রভৃতি গাছ জন্মে। বন্য প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় বানর, শূকর,
বনমোরগ, সাপ, শিয়াল, নেকড়ে, কাঠবিড়ালি প্রভৃতি। লতার মধ্যে রয়েছে কাঞ্চনলতা, আনিগোটা,
কুমারীলতা, শতমূলী, গিলা প্রভৃতি। এ ছাড়া এখানে অনেক ছনঘাস পাওয়া যায়। শালবনটির একটি
অংশ ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এটি ৮০ কিমি দীর্ঘ ও ৭ থেকে ২০ কিমি চওড়া।
এটি মধুপুর গড় নামে পরিচিত। আরেকটি অংশ শেরপুরে। এ অংশটি ৬০ কিমি দীর্ঘ ও ১.৫-১০ কিমি
চওড়া। এ ছাড়া শালবনের কিছু অংশ দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁয় অবস্থিত। বাংলাদেশের মোট
আয়তনের ৪.০৭ ভাগ ম্যানগ্রোভ বন। এসব বনের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ারভাটা হয়। ফলে এ বনের
গাছপালা বেশ লবণসহনশীল হয়। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, বাইন, ধুন্দুল, কেওড়া, গোলপাতা এসব
বনের প্রধান বৃক্ষ। এ ছাড়া এখানকার উল্লেখযোগ্য বন্য প্রাণী হলো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার,
চিত্রাহরিণ, বানর ইত্যাদি। শালবনের প্রধান বৃক্ষ শাল। এখানকার ৯০ ভাগ এলাকায় শাল গাছ
পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ একটি অংশ সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। রাস্তাঘাট,
রেললাইনের দুই ধার, স্কুল-কলেজের আঙিনা প্রভৃতি জায়গায় এ বনায়ন কর্মসূচি পালন করা হয়।
এসব কর্মসূচিতে স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। এসব সামাজিক বনে প্রধান বৃক্ষ
হলো ইউক্যালিপটাস, কড়ই, আকাশমণি, গোড়ানিম ইত্যাদি। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা যেমন খুলনা,
পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় উপকূলীয় বন অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৫ রাখ ২০
হাজার হেক্টর। প্রধানত সুন্দরী, গেওয়া, গরান, ধুন্দুল, আমুর, ডাকুর প্রভৃতি গাছ পাওয়া
যায়। এখানে ঝাউ, কেরু, পনিয়াল, কাঠবাদাম, পিপুল, নিশিন্দার দেখা মেলে।
জীবজগতের ৮০ শতাংশের
বসবাস বনে। প্রায় ৬০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের আবাসস্থল এ বন। এ ছাড়া উভচর প্রজাতির
৮০, পাখি প্রজাতির ৭৫ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রজাতির ৬৮ শতাংশের বসবাস বনে। কিন্তু ধীরে
ধীরে উজাড় হয়ে যাচ্ছে এসব বন। ডব্লিউডব্লিউএফের তথ্যমতে প্রতি বর্গ কিলোমিটার বন ১
হাজার পর্যন্ত জীব প্রজাতি ধারণ করতে পারে। এফএওর মতে বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সাল নাগাদ
প্রায় ১.৪ শতাংশ বন হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে অধিকাংশ বন ধ্বংস হচ্ছে দখলে মাধ্যমে। বন
বিভাগের তথ্যমতে সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বন দখলে চলে গেছে। ২০০১ থেকে ২০১৫
সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার একর বনভূমি দখল হয়েছে। এসব বন ধ্বংসের কারণে বিলুপ্ত হয়ে
যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশনের ২০১৫ সালের
প্রতিবেদনমতে বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ৩১। ১ হাজার ৬০০ প্রাণী প্রজাতির
৩৯০টি হুমকির মধ্যে রয়েছে। আর ৫০টির বেশি প্রজাতি ঝুঁকিতে আছে। আইইউসিএনের ২০০০ ও ২০১৫
সালের প্রতিবেদন তুলনা করলে দেখা যাবে এ বিলুপ্তির হার অত্যধিক। ২০০০ সালে বিলুপ্ত
প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ছিল ১৩। অর্থাৎ ১৫ বছরে ১৮টি প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে
যা ভয়াবহ বিলুপ্তির হারকে নির্দেশ করছে। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণীর মধ্যে রয়েছেÑডোরাকাটা
হায়েনা, ধূসর নেকড়ে, নীল গাই, সুমাত্রা গন্ডার, জাভা গন্ডার, ভারতীয় গন্ডার, শিঙাহরিণ,
মন্থর ভালুক ইত্যাদি। আইইউসিএনের মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় আছে হাতি, ভোঁদড়, রয়্যাল
বেঙ্গল টাইগার, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ, কাঠবিড়ালি,
কালো ভালুক প্রভৃতি।
বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বন উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উঠে এসেছিল। এতে বলা হয়েছিল, সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৮৪ একর বেদখল হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর সংরক্ষিত বন। বনভূমি দখল করে আছে এমন ৮৮ হাজার ২১৫ জন চিহ্নিত করা আছে। বনের জমি দখল করে এখানে শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে রিসোর্ট, বসতভিটাও বানানো হয়েছে। এমনকি বনের জমি দখল করে চাষাবাদও করা হচ্ছে। একটি তথ্যমতে ১ লাখ ৬০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বনভূমি দখল করে আছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বন বেশি হুমকির মুখে। ২৮ জেলায় দখলকৃত বনভূমি রয়েছে। বন বিভাগের তথ্যমতে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে কক্সবাজার। কক্সবাজার জেলায় দখলকৃত বনভূমির পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪৭১ একর। শেরপুরের বনের অবস্থাও খারাপ। এখানকার তিন উপজেলায় বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। চাষাবাদ করা হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ যৌথ অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলে থাকা ৭ একর ৫৩ শতাংশ বনভূমি উদ্ধার করেছে। এ উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সারা দেশেই এ রকম অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে বনভূমি উদ্ধার করতে পারলে তা হবে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ ও এর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ফিরে পাবে বেঁচে থাকার স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বনের সুরক্ষা জীবনের প্রয়োজনেই অপরিহার্য। বন ও ভূমি খেকোদের রুখতেই হবে।