সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ০৯:২০ এএম
ভয়াবহ বন্যায়
দেশের অনেক এলাকা প্লাবিত। এর মধ্যে ১২টি জেলা মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২৩ আগস্ট
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
৪৫ লাখ মানুষ, প্রাণহানি ঘটেছে ১৩ জনের। মানবিক এই বিপর্যয়ে মনে পড়ছে ওপার বাংলার শক্তিমান
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি তার ‘দাঁড়াও’ কবিতায় লিখেছেন , ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে,
তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও / মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও / মানুষ
বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও ...।’ তার এই কাব্যপঙ্ক্তি বর্তমান বাস্তবতায়
আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েকদিনের অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে
নেমে আসা পানিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের অনেকগুলো জেলার যে মর্মস্পর্শী চিত্র উঠে এসেছে
তা এক কথায় নজিরবিহীন। ফেনী ও কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলার চিত্র বলে দিচ্ছে বিগত কয়েক
যুগেও এমন ভয়াবহ বন্যা প্রত্যক্ষ করেনি ওই অঞ্চলের মানুষ। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় এমন ভয়াবহ দুর্যোগে দুর্গতদের
উদ্ধার, সাহায্য-সহযোগিতাসহ নানাভাবে যে-রকম তৎপর হয়ে উঠেছে তা সাধুবাদযোগ্য।
আমরা দেখছি, সরকারের
পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও মানুষ বানভাসিদের উদ্ধার ও
ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি যেভাবে সহযোগিতার হাত প্রসাারিত করেছে তাও সাধুবাদের দাবি রাখে।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগজুড়ে প্রবল বর্ষণ ও ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস ছিল নাÑ এই বার্তা
মিলেছে সংবাদমাধ্যমে। আমরা জানি, ১৮ আগস্ট দেশের বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র
থেকে শুধু নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। প্রতিবেশী উজানের দেশ ভারতের বন্যা-পূর্বাভাস
ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকেও এমন তথ্য জানানো হয়নি। ফলে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়ে বিপর্যস্ত
হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল। আমরা এও জানি, ভারত থেকে বড় ও আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস
থাকলে তা বিশেষভাবে জানানোর চর্চা দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের রয়েছে। কিন্তু এবার এর
কোনো অনুশীলন দেখা যায়নি। ২৩ আগস্ট প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে
প্রবল বন্যায় ভয়াবহ যে মানবিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে এই ক্ষত সহজে উপশম হওয়ার নয়। প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ আরেকটি ভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়াবহ বন্যার পেছনে রয়েছে ‘পানি রাজনীতি’।
২২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় উপদেষ্টাদের বৈঠকের পর ত্রাণ ও দুর্যোগ
উপদেষ্টা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ‘পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে হঠাৎ ভয়াবহ
বন্যার কারণ হিসেবে ভারতে বাঁধ খুলে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে দেশটির সঙ্গে
যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের অভিমত—বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী,
কুমিল্লাসহ ভারতের আমাদের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত অস্বাভাবিক
মাত্রায় বেশি ছিল। এ অঞ্চলে সচরাচর এমন ভয়াবহ বন্যা হয় না। বিগত প্রায় তিন দশক আগে
এ অঞ্চলে বড় আকারের বন্যা হলেও এর মধ্যে সে ধরনের বন্যা হয়নি। সরকারের বিশেষ নির্দেশনায়
প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান
সমন্বয় কেন্দ্র থেকেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ক্রমাগত বন্যা পরিস্থিতি যেভাবে
অবনতির দিকে যাচ্ছে, এর মোকাবিলা অনেক কঠিন হলেও আমরা প্রত্যাশা করি, সবার সহযোগিতায়
এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
সাফল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন অনুসৃত হয় তাও আমাদের অজানা নয়। এ বন্যায় ইতোমধ্যে
সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে, মাছের ঘেরগুলো প্লাবনে
ভেসে গেছে। গবাদিপশু নিয়ে অনেকেই পড়েছে গভীর সংকটে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ভারতের ত্রিপুরার
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ওই রাজ্যের একটি জেলার বিশাল জলাধার ডম্বুরের (প্রায়
৪১ বর্গকিলোমিটার) ‘স্নেকগেট’-এর তিনটির মধ্যে একটি খুলে দেওয়া হয়। পানির অস্বাভাবিক
চাপ থাকলে এই গেট খুলে দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তার আগে ভাটির দেশকে জানাতে হয়, যাতে তারা
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ভারতের তরফে
এমন কিছু জানানো হয়নি বিধায় আমরা মনে করি তাতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বরখেলাপ ঘটেছে।
এমতাবস্থায়ও বাস্তবতা
হচ্ছে, উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলই বন্যার একমাত্র কারণ নয়। আমরা দেশের ভেতরে যেভাবে
খাল-বিল, নদীসহ জলাশয় ভরাট করে ফেলেছি তাও বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্যতম একটি
কারণ। তা ছাড়া অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, এখন
সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে বন্যার্তদের উদ্ধারের পাশাপাশি ত্রাণ প্রক্রিয়া আরও জোরদার
করায়। সরকারের প্রচেষ্টা আর সামাজিক শক্তি যূথবদ্ধভাবে মানুষকে উদ্ধারের পাশাপাশি আশ্রয়দানসহ
বাঁচানোর যেসব আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে তা নিশ্চয় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে
থাকবে। যূথবদ্ধ এই উদ্যোগ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেমন বড় শক্তি জুগিয়েছে
তেমনি ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে ঠেকাতে পেরেছে। এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তদের
পুনর্বাসন করার ব্যাপারে আগাম ভাবনা ও প্রস্তুতির তাগিদও আমরা সমগুরুত্বেই দিয়ে থাকি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-কুমিল্লাসহ দেশের অনেক জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
হয়ে পড়েছে। অনেক জেলায় নেই বিদ্যুৎ, একইসঙ্গে মোবাইল ফোন সংযোগও। এক কথায় সার্বিকভাবে
যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা পরিস্থিতি আরও বেশি নাজুক করে তুলেছে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে
ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে স্থানীয় প্রশাসন ঘোষণা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের
বানভাসিদের পাশে থেকে সবার আগে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি সুপেয় পানি, পর্যাপ্ত
শুকনো খাবার এবং ওষুধসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর ব্যবস্থা আরও পর্যাপ্ত কীভাবে করা যায়, সেই
প্রচেষ্টাও জোরদার করতে হবে। আমরা সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। তাদের
আর্থিক সহায়তাদানসহ ত্রাণ তৎপরতায় বিশেষভাবে সম্পৃক্ত হওয়া মানবিক দায়। আমরা জানি,
দেশ নানাভাবে বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এমন প্রেক্ষাপটে
ত্রাণ ভাণ্ডারে জরুরি উপকরণ সামগ্রী সংরক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক তহবিলও মজবুত করতে হবে।
দুর্যোগকালে কেউ যাতে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে না ওঠে সেদিকেও সজাগ
দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, এসব ব্যাপারে বহুলাংশেই আমাদের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর নয়। আমরা
আশা করি, সম্মিলিত প্রয়াসে কাটিয়ে ওঠা যাবে
বিপর্যয়।