× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

তিন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত হোক

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ০৯:১৮ এএম

আব্দুল বায়েস

আব্দুল বায়েস

প্রয়াত প্রথিতযশা সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ‘ এ ব-দ্বীপে দালালি ছাড়া ফুলও ফোটে না, মেঘও নামে না।’ দালাল আর দুর্নীতি বাংলাদেশে সমার্থক শব্দÑইংরেজিতে যাকে বলে রেন্ট সিকিং ইকনোমি। কেউ বলেন লুটপাটের অর্থনীতি এবং অর্থনীতির রক্তনালি বলে খ্যাত ব্যাংকিং খাতে রাহুর দশা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা অভিনন্দনযোগ্য পদক্ষেপ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সিপিডি বলছে, বিগত বছরগুলোয় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিজনেস অলিগারক তথা স্বজন-পুঁজিবাদ তোষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অথচ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো অর্থনীতির লাইফলাইন। ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারে এত স্ক্যাম কোনো দেশে কোনো আমলে হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সদ্য গত আমলে সরকারি মহল থেকে দুর্নীতি দমনে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল; যেমন দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্সÑতার প্রতি সঙ্গত কারণেই জনগণের আস্থা ছিল জিরো। সরকার পতনের কিছুদিন আগ থেকে শুধু গেল কয়েক মাসে দুর্নীতিবাজদের যে তালিকা একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে তা থেকে ওই মাত্রায় আস্থাহীনতার কারণ আঁচ করা যায়। অথচ দুর্নীতি কমিশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। এ কমিশনের প্রাক্তন এক চেয়ারম্যানের ভাষায় দুর্নীতি কমিশন নাকি এক ‘নখ-দন্ত বিহীন বাঘ’; যার মানে সম্ভবত এই যে, ঘুড়ির নাটাই ওপরওয়ালাদের হাতে, কমিশনের কিছু করার নেই। যা হোক, ব্যাংকিং কমিশন তথা ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে বলার আগে দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলা দরকার কারণ এরা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

দুই

শুধু সরকারি কর্মচারীরাই দুর্নীতি করেন এমন কথা নেই, বেসরকারি খাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দুর্নীতির দুর্গন্ধ ভেসে বেড়ায়প্রতারণা, ভেজাল, সিন্ডিকেট ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্নীতি বিকাশ লাভ করে। বর্তমান বাংলাদেশে এর জলজ্যান্ত উদাহরণ ঋণ খেলাপ সংস্কৃতি এবং এর সহায়ক শক্তি বালু উত্তোলন, বালিশ কেনা প্রভৃতি আবার রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতির ছাপ আড়ালে-আবডালে থাকে না ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এমনকি লোকসভা নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি প্রধান আলোচনার বিষয়। শোনা কথা, ভারতে জনৈক রসিক ব্যক্তি বলেছেন, রাজনীতিবিদরা ও ডাকাতরা একই ধরনের কাজ করে, তবে উল্টো পরম্পরায়। ডাকাতরা প্রথমে ডাকাতি করে তারপর জেলে যায়; রাজনীতিবিদরা প্রথমে জেলে যান, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ডাকাতি করেন। আপাতত দুর্নীতির আসল হোতা প্রশাসনিক দুর্নীতির কথা না-ই বা বলা হলো।

তিন

মজার কথা, দুর্নীতি উন্নয়নের জন্য সহায়ক এমন তত্ত্ব এককালে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণায় শেকড় গেড়েছিল। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হলো এ প্রতিপাদ্য, ঘুষের টাকায় লাল ফিতার দাপট দূর করতে দ্রুত সিদ্ধান্ত হাতে পাওয়া সহজ হয়; ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, বাবুও কাবু হয় না। সুতরাং ফেলো কড়ি, মাখো তেল যেখানে বিধিবদ্ধ নিয়ম, সেখানে পদে পদে ঘুষের ভূমিকা সহজে অনুমেয়। অবশ্য এ প্রতিপাদ্যটি অসার প্রমাণ করেছেন পরবর্তী গবেষকরা। সাম্প্রতিক গবেষণায় দুর্নীতির চার ধরনের কুফল চিহ্নিত করা হয়েছে : সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি, সামস্তিক আর্থনীতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট, প্রকটতর সামাজিক বৈষম্য এবং নিরুৎসাহিত বৈদেশিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বলয়ে বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্নীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে এবং মনে করা হয় দুর্নীতির কারণে বছরে আমাদের জিডিপির ২-৩ শতাংশ খোয়া যায়। অর্থাৎ এ পরিমাণ দুর্নীতি না হলে সম্ভবত পদ্মা সেতুর মতো আরও তিনটি সেতু নির্মাণ করা যেত।

চার

এবার আসা যাক দুর্নীতি নির্মূল পদক্ষেপ প্রসঙ্গে করণীয় নিয়ে কিছু কথায়। একসময় ভাবা হতো, বেতন কম বিধায় সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ খায়। তবে বেতন বৃদ্ধি যে দুর্নীতি রোধে মোক্ষম অস্ত্র নয়, তার প্রমাণ স্বয়ং বাংলাদেশ; যেখানে দফায় দফায় বেতন ও দুর্নীতি উভয়েই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতোই তাদের কোণঠাসা অবস্থা; দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীর দাপটে তারা শান্তিতে থাকতে পারেন না। মুদ্রার জগৎ সম্পর্কে যেমন গ্রেসাম বলতেন, খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে দেয়। তেমন অবস্থা প্রশাসনেও, খারাপ কর্মচারী-কর্মকর্তার দাপটে সজ্জন উধাও।

দুর্নীতি হ্রাসে সর্বপ্রথম দরকার দুর্নীতিপরায়ণদের আইন অনুযায়ী সাজা দেওয়া। তার মানে আইনের শাসন কায়েম করা। যেমন হংকং, চিলি ও নিউ সাউথ ওয়েলসের অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া। বাংলাদেশে আইনের অভাব নেই, যেমন অভাব নেই আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার ঘটনাওসরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা, মামলাও হচ্ছে কিন্তু এসব মামলার বিরুদ্ধে আপিল করে তারা আপাতস্থিতাবস্থার সুযোগ নিয়ে সুদাসলে লাভবান হচ্ছেন। তেমন ঘটছে ব্যাংকের ঋণ আদায়ের জগতে। প্রলম্বিত শুনানি দুর্নীতির জন্য সোনায় সোহাগা! একটি বিখ্যাত উক্তি এ রকম : ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সব সমাজে সফল হয় না। শুধু যেসব দেশে প্রশাসনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন সেসব দেশে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব... মাঝে মাঝে অভিযান করে দুর্নীতি তাড়ানো সম্ভব নয়... আইন হলো মাকড়সার জালের মতো, যা ছোট ছোট পতঙ্গদের আটকাতে পারে, বড় পোকাদের ঠেকাতে পারে না।’

দুর্নীতিবিরোধী সরকারের সদিচ্ছা বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বপ্রথম সরকারকে সব ব্যবসা থেকে হাত গোটাতে হবে। মার্কিন সাংবাদিক উইল রজারসের ভাষায়, সরকারের কাজ হচ্ছে সরকারকে ব্যবসাবাণিজ্যের বাইরে রাখা যদি না ব্যবসায়ীরা সরকারের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করেন। একমাত্র একচেটিয়া ব্যবসা ছাড়া সরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেছে এমন নজির খুব কম। সরকারি ব্যাংক কিংবা বিমানের ব্যর্থতার কথা কে না জানে। তার পরও বলতে হয়, দুর্নীতি নির্মূলের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি সরকারি ব্যবসা সংস্থায় একজন ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিবিষয়ক মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বেঞ্চ বা অন্য কোনো উপায় বের করতেই হবে। দুর্নীতিবাজদের অন্যতম প্রধান ভরসাস্থল হচ্ছে বিচার বিভাগীয় দীর্ঘসূত্রতাতৃতীয়ত, সার্বিকভাবে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া যথা প্রশাসনিক, রাজস্ব, আমদানি-রপ্তানি, এমনকি নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি নির্মূল অধরা থেকে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশিআর এসব সংস্কারের বিরুদ্ধে যারা জোট পাকিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করে তাদের মধ্যে আছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এবং আমলা। শর্ষের ভেতর ভূত রেখে ভূত তাড়ানো যেমন অসম্ভব তেমন এসব সংস্কারবিরোধী গোষ্ঠী ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার আশপাশে থাকলে দুর্নীতি নির্মূল অভিযান ভেস্তে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, প্রযুক্তিনির্ভর কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রসার দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এবং সব শেষে প্রচণ্ড প্রকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল অত সহজ হবে বলে মনে হয় না। মোট কথা, একমাত্র সুশাসন পারে দুর্নীতিমুক্ত এক বাংলাদেশ উপহার দিতে সচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন থাকতে হবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পরতে পরতে। জনগণ যাতে সরকারকে বলতে পারে : হুজুর, আমরা আপনার কাছে কোনো উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে দুর্নীতিবাজদের সামলান।

পাঁচ

এও তো সত্যি কথা, দুর্নীতি দমনে কিংবা অর্থ পাচার রোধে সরকারের করণীয় নিয়ে জনগণ কিছু শুনতে আগ্রহী থাকে তারা যে একেবারেই কিছু শোনে না তা নয়, কিন্তু হতাশ হয় যখন দেখে কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অবারিত করা হচ্ছে নানান প্রণোদনায়। আরও হতাশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে, সরকারি সুযোগ সত্ত্বেও কালো টাকা সাদা করতে তেমন সাড়া মিলছে না। জনগণ জানতে চায় টাকা পাচারের, সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির উৎসগুলো বন্ধে এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার নির্দিষ্ট করে কী কী পদক্ষেপের কথা ভাবছে এবং অতীতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কতটা ফলদায়ক হয়েছে সে সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন উপস্থাপন অত্যন্ত জরুরি। আসল কথা হলো, অন্তত দুর্নীতি নির্মূলের ক্ষেত্রে সদিচ্ছাই সব নয়, একই সঙ্গে সঠিক পন্থা বাস্তবায়ন এবং তার যথাযথ তদারকি সদিচ্ছার সুফল কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়া যেমন হ্যামলেট নাটক সম্ভব নয়, তেমন অর্থনীতির চলমান অস্থিরতা কাটাতে চাই ব্যয় সংকোচন; যে ক্ষেত্রে অর্থ পাচার ও দুর্নীতি গুরুত্বপূর্ণ ছিদ্র বলে আমরা মনে করতে পারি। যত তাড়াতাড়ি এ ছিদ্র বন্ধ করা যায়, ততই মঙ্গল।

ছয়

আমরা আশা করি ব্যাংকিং কমিশন হলে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। তবে কমিশন যেন দেশের কিংবা নির্বাচন কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে না হয়। মূলত নির্বাচন কমিশন, ব্যাংকিং কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন যেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশেষত ভারতের মতো স্বাধীন এবং শক্তিশালী হয় এ ব্যাপারে গভীর মনোনিবেশ জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে অতিদ্রুত এ তিন কমিশনকে মেরুদণ্ডসহ জাতির সামনে উপস্থাপিত করাÑনট টুথলেস টাইগার অ্যানিমোর। আরও মনে করি, এ তিনটি প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কালেও তেমন কোনো উদ্বেগ থাকবে না। বস্তুত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মানে এ প্রতিষ্ঠাগুলোকে নির্ভয়ে নির্ভার কাজ করতে দেওয়া। বিচারব্যবস্থার সংস্কার তো না হলেই নয়।

  • অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা