পর্যবেক্ষণ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১৩:০৩ পিএম
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমরা জানি কোনো নির্বাচনে যে-ই জিতুক জনগণ জিতবে না। কারণ জনগণের পক্ষের কোনো
দল নির্বাচনে জোরালোভাবে থাকে না। নির্বাচনে যারা লড়ে তারা বুর্জোয়া দল; তাদের ভেতর
বিভাজন আছে। ক্ষমতায় যারা ছিল তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই নির্বাচন দিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের
অধীনে অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে কোনোটাই সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু দুই জোটেরই আদর্শগত অবস্থান
নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। সরকার বলেছিল তোমরা ভোট দাও, আমরা উন্নতি দেব। কিন্তু প্রশ্ন
থাকে, উন্নতি যে রাস্তায় সে রাস্তায় কি চলেছে? এ উন্নতির অর্থ তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে
বৈষম্য বৃদ্ধি। উন্নতি যা হয়েছে বা হচ্ছে সেটা কতিপয়ের। তাদের কেউ কেউ বুলেটের গতিতে
উন্নতি করছে এবং টাকাপয়সা যা করছে তা বিদেশে পাচার করছে। এ উন্নতিতে বঞ্চিত মানুষ,
যাদের সংখ্যা শতকরা আশি, তাদের উপকারটা কোথায়? উন্নতি যে ঘটছে তার কারণ মানুষের শ্রম,
আর বঞ্চিত তো হচ্ছে সেই শ্রমজীবীরাই, যাদের শ্রমের দরুন এত সব উন্নতি। বিরোধীদের আওয়াজটা
ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের। কিন্তু গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ওপর নির্ভর করে না, গণতন্ত্রের
মূল কথাটাই হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা, তার কথা কি
তারা ভেবেছেন?
দেশের প্রতিটি নির্বাচন যে কাজটা বেশ সুন্দরভাবে করে সেটা হলো বুর্জোয়াদের রাজনীতির
ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতার অধিকতর উন্মোচন। টাকার দৌরাত্ম্যের কথা বাদই দিলাম, সেটা
তো ঘটেই। কিন্তু দলবদল? সেটা ঘটে কোন টানে? সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
তিনি আওয়ামী লীগের শাসনের অত্যন্ত কঠিন সমালোচক ছিলেন, কিন্তু যোগ দিয়েছিলেন নৌকায়।
তার চেয়েও বড় ব্যাপার তিনি রাজনীতিতে এসেছেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে; ছিলেন বিএনপির
প্রথম সাধারণ সম্পাদক; দলের প্রার্থী হিসেবে এমপি, মন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট
পর্যন্ত হয়েছেন। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলতেন; বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন
ওই আদর্শের সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ প্রচারক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে।
চৌধুরী সাহেব যে আওয়ামী জোটে যোগ দিয়েছিলেন সেটা কি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে?
শেষ পর্যন্ত তার কি ধারণা হয়েছিল, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত
ছিল এবং ওই আদর্শের প্রচারক হিসেবে মানুষকে এত দিন তিনি বিভ্রান্ত করেছেন? তেমন একটা
ঘোষণা দিলে তবু বোঝা যেত যে দলবদলের ব্যাপারটা নিতান্ত সুবিধাবাদিতা নয়, ভেতরে সারবস্তু
কিছু আছে।
সুবিধাবাদ জিনিসটা নির্বাচনে বেশ ভালোভাবেই সামনে আসে, বারবার আসে। গত নির্বাচনেও
এসেছে, এর আগেও এসেছে। যার যেদিকে সুবিধা, তিনি সেদিকে গেছেন। গেছেন ইনাম আহমদ চৌধুরীও।
শোনা গিয়েছিল বিএনপির হয়ে লড়বেন। মনোনয়ন পাননি, না-পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছেন আওয়ামী
লীগে। এতকাল যে বিএনপিতে ছিলেন তার কারণ কী? সুবিধা? বিএনপির শাসনামলে তিনি প্রাইভেটাইজেশন
বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই বোর্ডের প্রধান কীর্তি আদমজী পাটকলের বিলোপসাধন। দেশের
জন্য কাজটা ছিল ভয়ংকর ক্ষতির অথচ তিনি বলেছিলেন, পাটকলটি একটা অজগর, সবকিছু গিলে খাচ্ছে,
তাকে শেষ না করলে পরিণতি দাঁড়াত ভয়াবহ। দেশবাসী কিন্তু জানে অজগর যদি থেকে থাকে তবে
সেটা হচ্ছে ওই প্রাইভেটাইজেশন; সবকিছু সে গিলে খেয়ে ফেলছে এবং অজগরপন্থিরা ধারণা দাঁড়
করানোর চেষ্টা করছেন যে প্রাইভেট মানেই ভালো, আর পাবলিক হচ্ছে জঘন্য।
প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান সাহেব যে আমলাতান্ত্রিক জীবন শেষে
রাজনীতিতে এসেছিলেন এবং দল বদল করলেন তাতে বোঝা গেল তার কাছে প্রাইভেটই আসল বিবেচ্য,
পাবলিক হচ্ছে প্রাইভেটের জন্য ব্যবহার্য এজমালি সম্পত্তি। বালাই ষাট, এটা তার একার
নীতি হবে কেন, এটা তো বুর্জোয়াদের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই যে এমপি হওয়ার প্রাণপণ
চেষ্টা, অঢেল টাকা ঢালা, এর পেছনে উদ্দেশ্য তো একটাইÑপাবলিককে ব্যবহার করে প্রাইভেটলি
বড় হওয়া। শিক্ষার মূল লক্ষ্য আমরা বলে থাকি মানুষ তৈরি করা। কিন্তু যে মানুষ আমরা
তৈরি করছি, সেটা পুঁজিবাদী মানুষ, সামাজিক মানুষ নয়। এ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিতরা নিজের
উন্নতি ঘটাতে পারবেন। কিন্তু নিজের মধ্যে সামাজিক হওয়ার বোধ জাগাতে পারবেন না। আবার
এখন ফেসবুকের মাধ্যমে একটা সামাজিকতা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এটা তো
খুব ছোট জগৎ। একটা পর্দার মধ্যে আটকে যাচ্ছে। সবার সঙ্গে মিশবে, আনন্দ করবেÑএটা সে
করতে পারছে না। অন্যের সঙ্গে পারস্পরিক আদানপ্রদান করার সুযোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই,
পাড়ামহল্লায়ও নেই।
রাজনীতিতে আদর্শহীনতার অভিযোগ অন্যায় নয়, কিন্তু আদর্শবাদ তো একটা আছে, না থাকলে
চলবে কেন? হ্যাঁ, আছে এবং তার নাম অন্য কিছু নয়, সুবিধাবাদ ছাড়া। সুবিধার টানেই তো
এককালের বড় বড় বামপন্থির কেউ কেউ চুপসে গিয়ে সরকারি দলে শামিল হয়েছিলেন, সাম্প্রতিক
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তেমন আভাস দেখা যাচ্ছে। সে টান এত প্রবল যে নিজের কী দশা হবে
তা খেয়াল করতে পারেন না; নিজেরা লজ্জা পান না, সে পাট আগেই চুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু
অনুসারীদের এবং বামপন্থাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলেছেন। একের সুবিধায় দশের অসুবিধা, নিয়ম তো
এটাই। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কাদা ছোড়াছুড়ি করতে কেউ দ্বিধা করে না। এটাই
দাঁড়িয়েছে আমাদের নির্বাচনের অনিবার্য সংস্কৃতি।
নির্বাচনে থাকবে যুদ্ধাপরাধীরা এবং ইসলামপন্থিরাও। তাদের গোপন আদর্শও ওই একইÑসুবিধাবাদ।
যেদিকে সুবিধা বেশি সেদিকেই যাবেন, সে-কাজে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। নির্বাচনের ঢালাও
টাকা যা খরচ হয় তার অনেকটাই যায় বেকার যুবকদের হাতে। এদের লুম্পেন বলা হয়। এরা দলের
ভক্ত নয়, টাকার ভক্ত। বাংলাদেশে কর্মের সংস্থান বাড়ছে না; মেহনতিদের শ্রমের ওপর নির্ভর
করা উন্নতি কর্মহীনতা কমাচ্ছে না, বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে বেকার সমস্যার ভয়াবহতা সবচেয়ে
বেশি, আতঙ্কগ্রস্ত করার কথা দেশের শাসক শ্রেণিকে, কারণ এ সমস্যা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে
প্রতিনিয়ত আঘাত করবে; নির্বাচন উপলক্ষে লুম্পেনরা হাতে নগদ টাকা পাবে, উৎফুল্ল হবে।
কিন্তু নির্বাচন শেষে এরা যখন দেখবে টাকার উৎস শুকিয়ে গেছে, তখন টাকার জন্য তারা নানা
রকমের অপরাধে লিপ্ত হবে। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়বে, খুন-জখম-ধর্ষণের ভয়াবহতা আগামীতে
তা যে আরও বাড়বে; এমনটা না-ভাবার কোনো কারণ নেই।
বেকারত্ব আমাদের মস্ত বড় সমস্যা। দেখা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে কাজের আগ্রহ আছে,
সামর্থ্য আছে, কিন্তু তারা কাজ পাচ্ছে না। উচ্চশিক্ষিত ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ এখন বেকার।
যারা কৃষিতে জড়িত, তারাও বেকার হয়ে যাচ্ছে। প্রান্তিক কৃষক এখন শহরে চলে আসছে। কারণ
গ্রাম থেকে তার আর জীবিকা অর্জিত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, কৃষকের চাষাবাদের জন্য যা প্রয়োজন,
যেমন বীজ, সার, বিদ্যুৎ কোনো কিছুর জন্য সে এখন আর সরকারের সাহায্য পাচ্ছে না। সেগুলো
ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। সুতরাং কৃষকের চাহিদা কৃষককে একাই পূরণ করতে হচ্ছে। কৃষক
তার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে ঋণ নিচ্ছে। ঋণ নিতে গিয়ে নানা কারণে সে শোষিত
হচ্ছে। তাদের যারা শোষণ করছে, তারা সবাই ব্যবসায়ী। এ ব্যবসায়ীরাই আবার রাজনীতির সঙ্গে
জড়িত। যদিও অংশটি খুবই ক্ষুদ্র। কিন্তু ক্ষুদ্র এ অংশটিই সমগ্র জনগণের ওপরে চেপে বসেছে।
ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে তারা জড়িত থাকায় রাষ্ট্রের সুবিধা কুক্ষিগত করে ফেলেছে। ফলে সাধারণ
মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। বামপন্থি আন্দোলন যদি শক্তিশালী করা না যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের
গতি মৌলবাদের দিকে ধাবিত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এখানে একটা বাস্তবতাও আছে। আমাদের
অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও অসচেতন হওয়ায় তারা মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। সামনের
অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ বামপন্থি আন্দোলন দৃশ্যমান না থাকায় মৌলবাদের মধ্য দিয়ে
মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পাবে।
মূল কথাটা হচ্ছে ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। ব্যক্তিমালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় যাওয়া। সে কাজটা করার নেতৃত্ব দিতে হবে দেশের বামপন্থিদেরই। কিন্তু মুশকিল হলো বামপন্থিরা শক্তিশালী নয়। তাদের শক্তিশালী হতে দেওয়া হচ্ছে না। কোনো সরকার তাদের পছন্দ করে না। বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকারও না। আর মিডিয়া তো পুরোপুরিই তাদের বিপক্ষে। পরিস্থিতির উন্নতি চাইলে ব্যবস্থা বদলাতে হবে। ব্যবস্থা না বদলালে অবস্থা বদলাবে না। তার কারণ হলো মিডিয়ার মালিকরা সবাই ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে। ইসলামপন্থি দলগুলো যে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে এবং সামাজিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তার প্রধান কারণ কিন্তু এই যে, ধনীদের মতো এরাও ধনীগরিবনির্বিশেষে ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসী। আগামী দিনে সে ক্ষেত্রে ইসলামপন্থি দলগুলোই হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেবে। সেটা যে ভালো কোনো ব্যাপার হবে না, তার প্রমাণ মার্কিন আধিপত্যে বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আমরা নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্য করতে চাইব না। দেশের ভবিষ্যৎ যে বামপন্থিদের শক্তির বিকাশের ওপরই নির্ভরশীল, সে সত্যটা ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছে। আগামী নির্বাচন তাকে আরও পরিষ্কার করে দেবে।