× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিচারব্যবস্থা সংস্কারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার যা হতে পারে

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪ ২০:৩৮ পিএম

বিচারব্যবস্থা সংস্কারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার যা হতে পারে

গত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে দেশে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিচার বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা। সুবিচার নিয়ে জনমনে তৈরি হওয়া নানা শঙ্কা এখনও বিদ্যমান। বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা এবং নানা ধরনের আইনি জটিলতা বিশেষ করে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক নাশকতা মামলায় অতীতে নানাভাবে মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। মামলাজট বিচার বিভাগের কার্যক্রমেও জটিলতা তৈরি করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিচারক, আইনজীবী, আইন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দেশের আইনি ব্যবস্থায় বা বিচার বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

বিচার বিভাগ বলতে সকল শ্রেণি ও পর্যায়ের বিচার ও আদালত ব্যবস্থাকে বোঝায়। আদালতে বিচারকগণ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচারকাজ সমাধা করবেনÑ এটাই অনুমিত। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এমনটি প্রত্যক্ষ করা যায়নি। যদিও সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর বহুল আলোচিত রায়ের আগে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের একমাত্র কাজ ছিল সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করা। তবে তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ খুব কম ছিল। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মূল প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে পরিহার করা হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতেই সাধারণে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন এই বলে যে, জবাবদিহিতা না থাকায় অনেক বিচারকই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি।

জনগণের বক্তব্য অনুসারে এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে অত্যন্ত জরুরি বিষয়গুলোকে দীর্ঘ তারিখে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নিরপরাধ ব্যক্তিদের যথাযথ কারণ ছাড়াই জামিন প্রত্যাখ্যান করে জেল হেফাজতে রাখা হয়েছিল এবং এমনকি পর্যাপ্ত প্রমাণ বা যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই দীর্ঘ মেয়াদে দোষী সাব্যস্ত এবং সাজা হয়েছে প্রমাণ বা নিছক শ্রবণ ও অনুমানের ভিত্তিতে। এভাবে ন্যায়বিচার আশাহীনভাবে ব্যর্থ হয় এবং অন্যায় রাজত্ব করে।

আগামীতেও যেন কোনোভাবে বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, বিচারকরা যেন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনÑ সেজন্য বিচার বিভাগকে আধুনিক, কার্যকরী, স্বাধীন ও শক্তিশালী করার জন্য নিম্নোক্ত সংস্কারের প্রস্তাব করছি।

১. অধস্তন আদালতের ন্যায় উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের একটি কঠিন প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সৎ, দক্ষ ও যোগ্যদের নিয়োগ দিতে হবে।

২. বিচার বিভাগীয় জবাবদিহিতা/জুডিসিয়াল ট্রান্সপারেন্সি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার-প্রদান সংক্রান্ত জনগণের অভিযোগগুলো বিবেচনার জন্য অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের সমন্বয়ে ‘জুডিসিয়াল ট্রান্সপারেন্সি কাউন্সিল’ বা ‘বিচারিক জবাবদিহি কাউন্সিল’ নামে একটি স্বাধীন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই সঙ্গে বিচারব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিচার এবং যথাযথ সুপারিশ প্রদানের যথাযথতা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. জামিনের আবেদনের শুনানি এবং নিষ্পত্তি করা উচিত তার দাখিলের দিনে বা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে; যেহেতু স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টিতে মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। কোনো নিরপরাধী ব্যক্তির যাতে এক ঘণ্টার জন্যও বন্দি বা কারাবাস না হয়Ñ তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

৪. উচ্চ আদালতে নতুন প্রবেশকারীদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্স করা উচিত এবং উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ন্যায়।

৫. শুনানির তারিখ ঠিক করায় আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান দরকার। সুপ্রিম কোর্টে মামলাগুলো শুনানির তালিকায় আসে না যদি না শুনানির তারিখ নির্ধারণের জন্য আনুষ্ঠানিক তারিখ ‘মেনশন’ করা হয়। এই বিধানটি বাতিল করা উচিত এবং মেনশনের জন্য অপেক্ষা না করে আদালতের নিজের দ্বারা শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা উচিত।

৬. সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন জরুরি। বেশিরভাগ লোকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে এবং আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে ঢাকায় আসতে পারে না। জনগণ যাতে সর্বোচ্চ আদালতে সহজে প্রবেশ করতে পারে তার জন্য বিভাগীয় সদর দপ্তরে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ থাকতে হবে।

৭. প্রধান বিচারপতি যদি প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় উন্নয়নমূলক কাজে সিংহভাগ সময় ব্যয় করেন, তাহলে তা বিচার বিভাগের জন্য আরও কল্যাণকর হবে। তিনি শুধু অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা সাংবিধানিক ব্যাখ্যার গুরুতর প্রশ্ন জড়িত এমন বিষয়ে আদালতে শুনানির জন্য বসতে পারেন। প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে আপিল বিভাগে যুক্তরাজ্যের মতো একজন রাষ্ট্রপতি থাকতে পারেন।

৮. বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। বিলম্বিত বিচার হলো ন্যায়বিচার অস্বীকার করা। তাই বিচার দ্রুত করার জন্য মামলার সংখ্যার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

৯. মামলাজট বিচার বিভাগের জন্য অভিশাপ। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজদের মামলার বিশাল ব্যাকলগ ক্লিয়ার করার জন্য চুক্তিতে নিয়োগ করা যেতে পারে।

১০. মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা প্রতিপালনে আরও যত্নবান হতে হবে। বিচার বিভাগের মান ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশাবলিকে আর বিলম্ব না করে কার্যকর করতে হবে।

১১. মর্যাদা (স্ট্যাটাস) কেস পর্যালোচনা করে অন্যান্য সার্ভিসের অফিসারদের মতো বিচারকদের আবাসন সুবিধা, গাড়ির লোন নগদায়নের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

১২. জেলা বিচার আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ পদোন্নতি, বদলি ও ছুটির ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব খর্ব করে হাইকোর্টের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। সেজন্য হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে পৃথক সচিবালয় চালু করতে হবে।

১৩. বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে নিজেদের বাজেট প্রণয়ন করবে। সেক্ষেত্রে কোর্ট ফিস, আদালত কর্তৃক জরিমানা থেকে প্রাপ্ত টাকা একত্রিত করে বিচার বিভাগের ফান্ডে জমা হবে এবং সেখান থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

১৪.আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং উইংয়ে আমলার পরিবর্তে বিচারকদের পদায়ন করতে হবে। কারণ লিগ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক ছাড়া একটি আইন সুষ্ঠুভাবে ড্রাফট করা সম্ভব নয়।

১৫. ভ্রাম্যমাণ আদালতের (মোবাইল কোর্ট) ক্ষমতা কমিয়ে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠা লাভ না করে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে শুধু জরিমানা আরোপের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে এবং কারাদণ্ডের ক্ষমতা তুলে নেওয়া উচিত।

১৬. আপিল বিভাগের জায়গায় একটি স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট বিভাগের জায়গায় স্বাধীন হাইকোর্ট থাকা আমাদের জন্য ভালো।

১৭. হাইকোর্টের জন্য একজন প্রধান বিচারপতি থাকা উচিত। আপিল বিভাগের জন্য একজন রাষ্ট্রপতিও থাকতে পারেন, যিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আদালতের সভাপতিত্ব করবেন এবং পরিচালনার ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।

১৮. জেলা ও দায়রা জজদের নতুন করে নিয়োগ না দিয়ে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে; যদি কোনো সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি না হয়।

১৯. প্রসিকিউশন সার্ভিস গঠন করে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), গভর্নমেন্ট প্লিডার (জিপি) এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগের জন্য একটি পৃথক প্রসিকিউশন সার্ভিস গঠন করা যেতে পারে এবং এ ধরনের নিয়োগের জন্য অবশ্যই নির্ধারিত নিয়ম থাকতে হবে।

২০. আলাদা নিরাপদ হেফাজতের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। বিচারাধীন আসামিদের রাখার জন্য একটি পৃথক সেফ কাস্টডি/জুডিসিয়াল কাস্টডি থাকা উচিত এবং এই ধরনের হেফাজত অবশ্যই জেল থেকে দূরে থাকতে হবে এবং ভিন্ন আকৃতি ও পরিবেশের হওয়া উচিত।


  • আইন গবেষক এবং কলাম লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা