পর্যবেক্ষণ
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪ ১১:৪৮ এএম
ড. ফরিদুল আলম
১৬ আগস্ট প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর একটা সংবাদ বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করল। সংবাদের শিরনাম ছিল ‘শিক্ষার্থীরা
গড়তে যাচ্ছে রাজনৈতিক দল’। বিগত সরকারের পতনের পর থেকেই এক ধরনের আলোচনা ছিল। অন্তর্বর্তী
সরকারের শপথগ্রহণের পর এ আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পায় ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কের
কথা থেকে। নতুন সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজনকে সম্পৃক্ত করার পর একজন
সমন্বয়কের কথা ছিল এ রকম, ‘সরকারের উপদেষ্টা হওয়া তাদের একটা বড় সেক্রিফাইস, সরকারের
অংশ হওয়ার ফলে তারা আগামীতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’ এর মধ্য দিয়ে এটা অনেকটা
পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আগামী নির্বাচনে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম
করে তারা অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। আর রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে যে কথাগুলো বিগত
সরকারের পতনের পর থেকে বলা হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত তত্ত্বও বোধকরি এখানেই রয়েছে।
বিষয়টি সাম্প্রতিক
সময়ে বহুলচর্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যখন এটা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আগামী তিন মাস
বা ছয় মাসের মধ্যে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
সেই সঙ্গে এও এখন ধীরে ধীরে অনেকের বোধের মধ্যে আসছে যে, গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক
ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধন না করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালনার
দায়িত্বভার অর্পণ করাও সমীচীন হবে না। সবকিছু মিলে আগামী দিনে যারাই রাজনীতিতে টিকে
থাকবেন কিংবা সরকার গঠন করবেন তাদের চিরাচরিত কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনার বাইরে গিয়ে
নতুন করে কিছু ভাবতে হবে। আর এটাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা
হয়েছিল, এ সরকারের মূল কাজ হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের কাছে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা অর্পণ করা। সরকার গঠনের কিছু আগে থেকেই এ বিষয়ে
জনমনে জিজ্ঞাসা কাজ করতে শুরু করে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের শপথগ্রহণের পর থেকেই এ সরকারের
মেয়াদকাল নিয়ে তা স্পষ্ট হতে থাকে। এ সরকারের মেয়াদ নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না পাওয়া গেলেও
যদ্দুর জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে দায়িত্ব নেওয়া সরকারের মেয়াদকাল
তত দিনই থাকবে যত দিন এ সংস্কারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জিত হয়। এ রাষ্ট্র সংস্কার
ধারণাটি সে রকম স্পষ্ট না করলেও আমাদের মতো আমজনতা এটিকে নিজেদের মতো করে একটি ব্যাখ্যায়
উপনীত হতে পেরেছি। এ ব্যাখ্যাগুলো হলো এ রকম : প্রথমত, বিগত সরকারের আমলে দেশের সর্বস্তরে
দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, রাতারাতি এর উপশম না করে যদি
নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাহলে অবস্থার
সে রকম উন্নতি হবে না, বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও বিষময়
করে তুলবে। দ্বিতীয়ত, সর্বস্তরে দলীয়করণ যেভাবে জেঁকে বসেছিল, এ জায়গা থেকে দেশকে মুক্ত
করে সত্যিকার অর্থে যোগ্যদের স্থান করে দেওয়া এবং বিগত সময়ের বিরাজনীতিকরণের সংস্কৃতি
থেকে দেশকে উদ্ধার করা। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা
করা, যাতে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারগুলো সত্যকার অর্থে জনস্বার্থ আমলে নিয়ে রাষ্ট্রের
শাসনকাজ পরিচালনা করতে সচেষ্ট থাকে।
ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর
দিকে এমরা যদি একটু মনোনিবেশ করি তাহলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, আওয়ামী লীগ
সরকারের পতন হলেও যদি সংবিধান মোতাবেক দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয় তাহলে নিঃসন্দেহে দেশে বর্তমানে বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে যারা রাজনৈতিকভাবে
বর্তমানে প্রভাবের জায়গায় রয়েছে, তারাই সরকার গঠন করবে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের
উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের যে লক্ষ্যগুলো অনুমিত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের আর
কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে অতীতের দিনগুলোর মতো আবারও
রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে এবং একই কায়দায় অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা সংঘটিত হতে পারে।
এ অবস্থা উত্তরণের জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা
করা। তবে এর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল সংস্কারসাধন। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ
কোনোভাবেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সহায়ক নয়।
এ ধরনের আলোচনাগুলোই
বর্তমান সময়ে সর্বাধিক উচ্চারিত হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের সচেতন এবং শান্তিপ্রিয়
মানুষমাত্রই বর্তমান ধারার গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এ অবস্থায়
শিক্ষার্থীরা একটি সফল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটালেও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক
ব্যবস্থা এবং সরকার পরিচালনায় তাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি রয়েছে।
একই রকম প্রতিক্রিয়া রয়েছে খোদ ছাত্রসমাজের মধ্যেও। সাম্প্রতিক গণআন্দোলন-পরবর্তী সময়ে
রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ এমনটা মনে করছেন যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের
পথ ধরে যে সফল গণঅভ্যুত্থানটি ঘটে গেল, এটি পুঁজি করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এ আন্দোলনের
চেতনার পরিপন্থি। অন্য একটি অংশ মনে করছে, এ নিয়ে তারা আগামী এক মাস সমাজের বিভিন্ন
অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা এবং মতবিনিময় করে রাজনৈতিক দল গঠন করা-না করা বিষয়ে সিদ্ধান্ত
নেবেন। দেশের সুশীলসমাজের মধ্যেও এক ধরনের অনুপ্রেরণা রয়েছে এ তরুণসমাজের ভবিষ্যৎ ভূমিকা
নিয়ে। নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার দায়িত্বগ্রহণের প্রাক্কালে
একটি সফল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সূচনা করার জন্য অরুণসমাজকে অভিনন্দন জানিয়ে
বলেন, ‘তরুণসমাজের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। দেশের দায়িত্ব তাদের হাতেই থাকা উচিত, বৃদ্ধ
প্রজন্মের হাতে নয়। তরুণ প্রজন্মের হাতে দায়িত্ব দিয়ে নিজেদের মতো তাদের দেশকে গড়ে
নিতে দেওয়া উচিত। এটা তাদের দেশ। তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এটা আমরা দেখেছি।’
আমরাও কখনও চাইব
না ছাত্রসমাজের সফল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নতুন ধারার সূচনা হলো এখানে কোনো সুবিধাবাদী
গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মূল চেতনার জায়গাটিতে আঘাত আসুক। সেই দৃষ্টিকোণ
থেকে আমাদের বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ের গভীরে গিয়ে এর মর্মার্থ
অনুধাবন করতে হবে। সেই দৃষ্টিতে দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্য দলগুলোর
অযাচিত আস্ফালন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে এও আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে
হবে যে ছাত্রসমাজের এ আন্দোলন এবং এর মধ্য দিয়ে যে ফসল গণঅভ্যুত্থান সূচিত হয়েছে, এটা
ছিল একটা সময়ের দাবি। এর মধ্য দিয়ে রাতারাতি তাদের হাত ধরেই রাজনৈতিক দল গঠন করে সরকার
পরিচালনা করার মতো জায়গায় যাওয়ার অবস্থায় আমরা পৌঁছেছি কি না ভেবে দেখা জরুরি। আমাদের
সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে আজকের যারা ছাত্র, তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা
এবং সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করা।
নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক
সম্পৃক্ততা প্রকৃতির নিয়মেই গড়ে ওঠে। যে সময় যে কাজে মনোনিবেশ করার কথা, সে সময়ে সে
কাজে সঠিকভাবে ব্যয় করাই অধিক সমীচীন। একই সঙ্গে এও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে ভবিষ্যতে
যে সরকারই গঠিত হোক না কেন, সেখানে সর্বস্তরের প্রতিনিধত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়, ছাত্রসমাজের
তো বটেই। একই সঙ্গে বর্তমান ছাত্রসমাজ যেভাবে তাদের সক্ষমতার প্রকাশ ঘটাল এটা থেকে
আমরা অনেক বেশি আশাবাদী হতে চাইÑএর মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটবে,
উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দলীয় রাজনীতির নামে ছাত্রসমাজের ধ্বংসাত্মক তৎপরতার অবসান
ঘটবে এবং বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটি বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
বর্তমানে আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায়
রাখতে হবে এবং ছাত্র-শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্র এবং শিক্ষক-শিক্ষকের মধ্যকার রাজনৈতিক ভেদাভেদ
অতিক্রম করে যার যার পেশাগত দায়িত্বের প্রতি সচেষ্ট থাকা উচিত।
একটি সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে যতটা সময় লাগুক, জাতি এ সময়টুকু অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে রাজি রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিগত সরকারের অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গোটা জাতি এক হয়েছিল। এ চেতনা ধারণ করে চলা সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একতরফাভাবে বিগত সরকারের সমালোচনার মধ্য দিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যথেচ্ছচারও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অপকর্মের সঙ্গে দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ যেমন সবার প্রাণের দাবি, একই সঙ্গে ছাত্র-জনতাকেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সরকারের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা একান্ত কর্তব্য।