শ্রদ্ধাঞ্জলি
ড. হারুন রশীদ
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪ ১১:৪০ এএম
সেলিম আল দীন
আজ ১৮ আগস্ট।
বাংলা নাটকের গৌড়জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের জন্মদিন। তার নাটকই বাংলা থিয়েটারের
বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই
জন্ম নেওয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদান ছুঁয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই
বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী
জেলার অন্তর্গত সমুদ্রবর্তী সোনাগাজী উপজেলার সেনের খিলে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রোত্তর
বাংলা নাটকের প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন।
১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর পর থেকেই তার কর্মক্ষেত্র
বিস্তৃততর হতে থাকে। একদিকে সৃজনশীলতার ভুবন আলোকিত করে রাখেন তার নতুন নতুন ভিন্নমাত্রিক
রচনাসম্ভার দিয়ে, অন্যদিকে শিল্পের একাডেমিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির জন্য কাজ করে
যান সমান্তরালে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উদ্যোগেই খোলা হয় নাটক
ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এ বিভাগকে তিনি অধিষ্ঠিত
করেন মর্যাদার আসনে। অধ্যাপনার পাশাপাশি এ দেশের নাট্যশিল্প বিশ্ব নাট্যধারার সঙ্গে
সমপঙ্ক্তিতে সমাসীন করার লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম
থিয়েটার। এর আগেই অবশ্য তার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাট্যনির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের
সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্ডিস ও বিবিধ
বেলুন, মুনতাসির, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা,
হরগজ, বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল ইত্যাদি মঞ্চসফল ও পাঠকনন্দিত
নাটক রচনার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন। তিনি অবশ্য তার
সৃষ্ট শিল্পের কোনো নাম দিতে চাননি। তার ভাষায়Ñ ‘আমি চাই আমার শিল্পকর্মগুলো নাটকের
অভিধা ভেঙে অন্যসব শিল্পতীর্থগামী হয়ে উঠুক।’ আখ্যান বা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে লেখা
উপাখ্যানগুলোয় তিনি কাব্য, উপন্যাস, চিত্রকর্ম প্রভৃতি শিল্পধারা এক মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়
উপস্থাপন করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষেরও তিনি প্রণেতা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক
এথনিক থিয়েটারেরও তিনি উদ্ভাবনকারী। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়,
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের
পাঠ্য।
রক্তের আঙুরলতা, অশ্রুত গান্ধার, গ্রন্থিকগণ কহে, ভাঙনের শব্দ শুনি, অনৃত রাত্রি, ছায়াশিকারী, রঙের মানুষ, নকশীপাড়ের মানুষেরা, প্রত্ননারী, হীরাফুল প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয় টিভিনাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে পান জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার। ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। বর্ণময় কর্মজীবনে দেশে-বিদেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। কিন্তু রেখে যান তার অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সৃষ্টিসম্ভার। যে জীবন তিনি ধারণ করেছিলেন তা যুগস্রষ্টা শিল্পীর জন্য স্বল্পায়ুর, কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেন এবং ছুঁয়েছিলেন তার ব্যাপ্তি সীমাতীত। গবেষকদের বিবেচনায়, মহান স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মহার্ঘতা তার রচনায় নতুন মাত্রা লাভের ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। জাতীয় সাহিত্যের ভিত তিনি রচনা করে দিয়েছেন।