× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রনাথ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৪৬ পিএম

জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রনাথ

প্রথম কথা, ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ তার দেশকেই পেতেন না খুঁজে। তাকে আমরা বিশ্বকবি বলি, বলা হয়েছে তাকে ভারতপথিক, তাদের পারিবারিক পত্রিকার নাম ছিল ‘ভারতী’। ভারতবর্ষের কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার ভেবেছেন; কিন্তু প্রথমত ও প্রধানত তিনি বাংলারই মানুষ; বাঙালি তিনি, বিদ্যাসাগরের মতো; এবং রামমোহনের তুলনায় অধিক। হাঁপিয়ে উঠতেন শহরে, চলে যেতে চাইতেন গ্রামে। আজ ফিরে আসতেন যদি তার বাংলায়, দেখতেন কেউ কেউ তার কবিতা পড়ছে ঠিকই, কিন্তু হায়, তার সেই বাংলা তো নেই, ভাগ হয়েছে, এক ভাগ চলে গেছে ভারতে, অন্য ভাগ প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশের। এক নেই, অবিভক্ত নেই। সোনার বাংলা দূরের কথা, মাটির বাংলাটিও পেতেন না খুঁজে।

১৯০৫ সালে ভাগ করার চেষ্টা হয়েছিল বাংলা। প্রতিরোধ হয়েছে। প্রতিরোধের সামনে রবীন্দ্রনাথ, আপনি ছিলেন। কিন্তু ৪২ বছর পরে আপনি তখন নেই, বাংলা তখন ভাগ হয়ে গেল দুই খণ্ডে, বাঙালিই তো করল, বাঙালি পরিচয়ে নয়, হিন্দু ও মুসলমান পরিচয়ে। দেশ ভাগ হয়েছে কিন্তু তিনি ভাগ হননি- এ বোধ তাকে সান্ত্বনা দেবে এটা ভাবা যায় না। ভারতের যেমন বাংলাদেশেরও তেমন জাতীয় সংগীত তার রচনা থেকেই এসেছে; তাৎপর্যপূর্ণ এ সত্যও তার দুঃখ দূর করবে না, বরং জাগিয়ে দেবে। কেননা তিনি গৃহহীন হতে চাননি, কখনও ভাবেননি যে উদ্বাস্তু হবেন। আজ এলে দেখতেন পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি প্রদেশমাত্র, তার অধিবাসীরা নিজেদের বাংলার লোক বলে, কিন্তু বাঙালি বলে না, বলে ভারতীয়; এবং ভারতীয় বাঙালি আজ হিন্দির আক্রমণে বড়ই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, এমনকি নিজের ঘরেও তার জন্য নিরাপদ আশ্রয় নেই, কেননা সেখানেও হিন্দিভাষী টিভি চ্যানেল এসে হানা দিচ্ছে সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাত্রে।

ওদিকে তার গান গাইতে গাইতেই স্বাধীন হয়েছে পূর্ববঙ্গ, এ কথা তিনি জানবেন ঠিকই; কিন্তু পরবর্তী বাস্তবতা দেখবেন অন্যরকমের। দেখবেন এখানে অধিকাংশ মানুষ এখনও অশিক্ষিত, দেখবেন সমাজের উচ্চতর অংশে বাংলা কাবু হচ্ছে, ইংরেজির হাতে পড়ে। শুনবেন এবং শিউরে উঠবেন শুনে যে, লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে। মানবিক গুণ যদি আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট থেকে থাকে, তবে কিছুতেই আমরা চাইব না যে রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসুন তার বাংলায়। কেননা ফিরে এলে বড়ই আঘাত পাবেন। দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল জীবনে আঘাত রবীন্দ্রনাথ কম পাননি। শোকে জর্জরিত হয়েছেন পত্নী, সন্তান, ভ্রাতৃবধূর মৃত্যুতে। ব্যক্তিগত দুঃখ বহন করেই চলেছেন তিনি, সামনে। কত যে সংবেদনশীল ছিলেন সে তো তার লেখা পড়েই বুঝি; কিন্তু ভেঙে পড়েননি কখনও। ছিলেন রোমান্টিক এবং সব সময়ই আশাবাদী। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড তাকে অস্থির করেছিল। শেষ জীবনে অতিনিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র নখ ও দন্ত নিজের চোখের সামনে উন্মোচিত দেখেছেন।

কিন্তু আমাদের এ নতুন শতাব্দীতে ফিরে এলে যে আঘাতটা তিনি পেতেন তেমনটি হয়তো আগে কখনোই পাননি। পরিমাণের কথা ভাবছি না, গুণের কথা ভাবছি। তাকে মুখোমুখি হতে হতো সমষ্টি জীবনের এমন সব মৃত্যুর যাদের সহজে গ্রহণ করা তার মতো অসামান্য মানুষের পক্ষেও কঠিন হতো। সত্যকে সহজে নেওয়া সত্যি কঠিন। অশুভকে রবীন্দ্রনাথ জানতেন। অশুভকে উপস্থিত দেখি তার ‘শিশুতীর্থ’ কবিতায়, দেখি তার অনানুষ্ঠানিক চিত্রকলায়, আরেকভাবে দেখি তার উপন্যাসে এবং নাটকে; কিন্তু সর্বত্র অশুভ ছিল নিয়ন্ত্রণের ভেতর। আজ ফিরে এলে দেখতে পেতেন নিয়ন্ত্রণ পড়েছে ভেঙে। পশু রাজত্ব করছে, মানুষ পালাবার পথ খুঁজছে আত্মরক্ষার বিবরে। অতীতের মন্বন্তরের খবর জানেন আপনি, কিন্তু আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কীভাবে উৎপাটিত, নিগৃহীত ও হতাহত হয়েছে আপনার দেশের মানুষ, ১৯৭১-এ। আরও একটি গণহত্যার সংবাদও সহ্য করতে হবে, রবীন্দ্রনাথ, আপনাকে। সেটি ঘটেছে আপনার চলে যাবার দুই বছর পরে, ১৯৪৩-এ। বলা হয় মন্বন্তর, আসলে ছিল গণহত্যা। সঠিক হিসাব নেই, হিসাব নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না রাষ্ট্রের, কেননা মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল তারাই। নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষ। মন্বন্তর হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেও, ১৯৭৪-এ। প্রাণ হারিয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। কেমন করে সহ্য করতেন এসব সত্য আপনি, ফিরে এলে? জানি আমরা মানুষের ওপর আস্থা হারাবেন না তবু, কিন্তু আঘাত তো পাবেন। সংবেদনশীল হৃদয়ে রক্তপাত কেন ঘটাব আমরা আপনাকে ডেকে এনে, কোন অধিকারে?

আবার এলে রবীন্দ্রনাথ বিষণ্ন চোখে দেখতেন কেবল যে দেশভাগ হয়েছে তা নয়, প্রকৃতিও গেছে বদলে। তিনি সব ঋতুরই কবি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবি তিনি বর্ষারই। দেখতেন বর্ষা নেই বাংলায়। প্লাবন আছে, আছে খরা; দুই চরম জাপটে ধরেছে বঙ্গভূমিকে। যে নদী ছিল খরস্রোতা অথচ ফসলদায়িনী সে কোথায় গেছে হারিয়ে। বাঁধ পড়েছে তার বক্ষে। পদ্মা নেই, গঙ্গার জলও উত্তর ভারতে গমনেচ্ছু। বর্ষা পাবেন কোথায়, বর্ষাকে তো শেষ করে দিয়েছে মানুষ। নদী ভাগ করে এবং জনপদে যত গাছ ছিল তাদের অধিকাংশ কেটে ফেলে। কেউ কেটেছে অভাবে, কেউ কেটেছে মুনাফার লোভে। ওই লোভের ব্যাপারটা বড়ই নির্মমভাবে সত্য। জাতীয়তাবাদ রবীন্দ্রনাথ ঘৃণা করতেন জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত বস্তুগত লিপ্সার কারণে। আজ এলে দেখতেন তার ঘৃণিত লোভ কত প্রবল হয়েছে।‘যোগাযোগ’-এর মধুসূদন কবি নয়, সে একটি লোমশ প্রাণী; বড় মাপের ও ছোট মনের ব্যবসায়ী। কুমুকে সে গ্রাস করে নিয়েছিল টাকার জোরে। পৃথিবীজুড়ে আজ ওই লোমশ মধুসূদনদের দাপট। কুমুরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্থানীয় সংস্কৃতি, মানুষের অন্তর্গত শুভ ও সুন্দরের বোধ, সবকিছু বিপন্ন, ব্যবসায়ীদের দানবীয় হস্তক্ষেপে। তাদের জিব থেকে লালা ঝরে, শ্বাস থেকে আগুন।

একজন মধুসূদন আপনাকে পীড়িত করেছিল। আজ এলে দেখতে পেতেন লাখ লাখ মধুসূদনকে। কে রুখবে তাদের? কুমুর ভাইয়েরা পরাজিত, নয়তো ভীতসন্ত্রস্ত, অথবা আত্মসমর্পিত। বণিকের পুঁজি এখন ক্রমাগত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আজ তারা সীমান্ত মানে না। জাতীয় স্বাধীনতা খড়ের পুতুল তাদের কাছে। তারা লিখিত-অলিখিত নানা ধরনের চুক্তি সই করিয়ে নিয়েছে দুর্বল দেশগুলোকে দিয়ে। বণিকেরা এখন পণ্য গেলাবে, একদা যেমন করে তারা আফিম গিলিয়েছিল অনিচ্ছুক চীনাদের, যার ছবি রবীন্দ্রনাথ, আপনার লেখায় আছে। পণ্য গেলাবে এবং কাঁচামাল যেখানে যা আছে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবে। বলবে ব্যবসায় করছি।

আপনি বুঝবেন জাতীয়তাবাদকে ঢালাওভাবে যে প্রত্যাখ্যান করব আমরা সেটা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক দস্যুদের রুখতে হলে জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন হয়। তবে মুশকিল এই, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ তাদের অভিসার পুঁজিবাদমুখী। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ভারত-পাকিস্তানের সৃষ্টি। আসলে জাতীয়তাবাদ নয়, সেটা ছিল নির্ভেজাল সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার দুষ্ট চরিত্রকে রবীন্দ্রনাথ জানবেন না তো কে জানবে? স্বদেশি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে হিন্দু বাবু ও মুসলমান কৃষকের ভেতর একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ তা শঙ্কার সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু ওই সাম্প্রদায়িকতা যে এত প্রবল হবে, এমন মারাত্মক হয়ে উঠবে, শক্তি সঞ্চয় করবে সমাজের অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্ব থেকে তা রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি। আবার যদি আসতেন তিনি তবে অসহায়ভাবে শুনতেন জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে রক্তে প্লাবিত করেছে বঙ্গভূমি এবং ভাগ করেছে মানুষ ও মাটি; সেই মর্মান্তিক কাহিনী।

তার পরও দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী হয়নি বাঙালি। একাংশ তো মিশে গেছে ভারতে। আর যে অংশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে স্বতন্ত্র তাদের শাসক শ্রেণির সবাই আগ বাড়িয়ে বলে যে তারা জাতীয়তাবাদী; কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা কেউই তা নয়। বাংলাদেশের একদল তো বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছিল। তাতে কোনো অন্যায় থাকত না যদি সেটা রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের পরিচয় হতো। তা তো নয়। নাগরিকতাকেই তারা জাতীয় সত্তা বলে তুলে ধরতে চেয়েছিল। আর যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে প্রচার করে তারাও মোটেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নয়। সাম্রাজ্যবাদ এখন বণিক পুঁজির রূপ নিয়ে নিয়েছে। সে বলে বাণিজ্য করবে। অর্থাৎ লুণ্ঠন করবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠনের খবর আমরা শুনেছি; বহুজাতিক করপোরেশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ইত্যাদির লুণ্ঠন আমরা দেখছি। এ লুণ্ঠন আরও সর্বব্যাপী এবং সূক্ষ্ম। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়াটা কঠিন।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা