× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পেশাগত অঙ্গীকারই মূল কথা

মোহাম্মদ নুরুল হুদা

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪ ১৭:০০ পিএম

পেশাগত অঙ্গীকারই মূল কথা

দেশের বিভিন্নস্থানে হামলা, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। এ সময় অধিকাংশ থানাই পড়েছিল অরক্ষিত অবস্থায়। নিরাপত্তাহীনতায় থানায় দায়িত্বপালনের জন্য পুলিশসদস্যরা ছিলেন না। এ অবস্থায় কিভাবে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে মানুষের নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করা যায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এটি ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন মহল থেকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ারও তাগিদ আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত কয়েক দিনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে কাজ শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও তাদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে ফিরতে শুরু করেছেন। পুলিশের শূন্যতা পূরণে গত কয়েকদিন দেশে বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক কন্ট্রোলসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতে ছাত্র-জনতা যে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেজন্য তাদেরকে আমার অভিনন্দন। এটি শুভ দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে থাকবে।  

আমরা দেখছি, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পুলিশসদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করায় বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের অভিযোগও ক্রমাগত ওঠে। সাধারণ মানুষ এ সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং উদ্বেগোকুল সময় পার করেছে যা তাদেরকে প্রতি মুহূর্তে অসহায় বোধ করিয়েছে। পুলিশ বাহিনীর কাজে যোগদানের মাধ্যমে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। অবস্থার আরও উন্নতির জন্য এ মুহূর্তে নিয়মিত বাহিনীতে যারা আছেন তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা রয়েছেন, তাদের অধস্তনদের কাজের জন্য নিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা মূল দায়িত্বে আছেন, তাদের কাজের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে আনসার-ভিডিপিবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে পুলিশের পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে ফিরে আসার কোনো বিকল্প নেই। 

দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পুলিশের ওপর জনআস্থা অনেকটাই কমতে শুরু করে তা অসত্য নয়। এখন হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশকেই তাদের কাজের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তারা ফিরে আসছেন সেহেতু নিরপেক্ষভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে জনআস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন কিছু হবে না। পুলিশের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুলিশকেই জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। কিন্তু এজন্য আরও সময় প্রয়োজন। এত দ্রুত সমাধান হবে না। তবে কাজ শুরু করলে একসময় ফল আসবেই। আমরা দেখে আসছি, অতীতে পুলিশ রাজনৈতিক নির্দেশনায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন আনা জরুরি। পুলিশ আইনের ভেতরে থেকে কাজ করলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পুলিশকে আইন মেনে কাজ করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো অবকাশ নেই। পুলিশের জন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। পুলিশের মধ্যেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়নের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। 

পুলিশ সদস্যদের কাজ শুরু করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে। পুলিশ জনগণের বন্ধু। এই সম্পর্কে চিড় ধরেছে রাজনৈতিক কারণে তাও অস্বীকার করার অবকাশ ক্ষীণ। এক্ষেত্রে শুধু পুলিশের ব্যর্থতা দেখলেই চলবে না। পুলিশ জনকল্যাণমূলক কাজও কম করেনি বা করছে না। ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্ত করে বিচারের পথ মসৃণ করা পুলিশের গুরুদায়িত্ব। পুলিশ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও সংস্থা রয়েছে দায়িত্বরত। সবারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার প্রমাণ রাখতে হবে। বিভিন্ন কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়। নজর দিতে হবে কারণগুলোর দিকে। আগেই বলেছি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও অনেক কারণের সৃষ্টি হয়, যেগুলোর সবই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বাহিনী বা সংস্থার ব্যর্থতা এভাবে নির্ণয় করা সমীচীন মনে করি না।

সংবাদমাধ্যমের নানা সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে দেশে ১ লাখ ২০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, পুলিশবাহিনীর প্রায় অর্ধেক নিয়োগই দেওয়া হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমরা দেখছি, পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অতীতে সব রাজনৈতিক সরকারই কমবেশি ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। ফলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ভালো ফল বয়ে আনেনি। সময়ের চাহিদা অনুসারে প্রতি বছর পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়। অধিক জনসংখ্যা বহুল এ দেশে মানুষের অনুপাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অপ্রতুলÑএ বাস্তবতাও কিন্তু অস্বীকারের উপায় নেই। তবে বিগত ১৫ বছরে পুলিশ বাহিনীতে সব সদস্যের নিয়োগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়েছে তা সোজাসুজি বলা সম্ভব নয়। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদেই নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রতি বছর সম্পন্ন হয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তা ছাড়া জননিরাপত্তা খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোও ছিল সময়ের বড় তাগিদ। তাই বিগত ১৫ বছরে এত পুলিশ নিয়োগের বিষয়টিকে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অংশ তা বলা যাবে না।

আমরা দেখেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন কোটা সংস্কারের দাবি করে তখন ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশকে পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে পুলিশবাহিনী মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করতে গিয়ে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। প্রকৃত অবস্থার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার বিষয়ে তাদের আগ্রহ দেখা যায়নি এবং সম্ভবত বিষয়টি তারা অনুধাবন করতে পারেনি। ইতোমধ্যে পুলিশবাহিনীর অনেকেই এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তারা ইতোমধ্যে তাদের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে কিছু দাবি জানিয়েছেন। তারা কোনো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অংশ হবেন না এবং রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কোনো সরকারি বা ক্ষমতাসীন দল তাদের ব্যবহার করতে পারবে নাÑ এমন কিছু দাবি তারা করেছেন। তাদের এসব দাবি অবশ্যই যৌক্তিক। তাদের যারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, ওই হীনস্বার্থবাদীদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। 

এ মুহূর্তে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আর তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশের শতভাগ প্রচেষ্টা কাম্য। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে পুলিশ তাদের দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবে না এবং তা বাঞ্ছনীয়ও নয়। বরং কর্মক্ষেত্রে ফিরে যদি তারা নিজেদের দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করবেন তখন সাধারণ মানুষও তাদের সদিচ্ছা বুঝতে পারবে। আর তখন পুলিশের দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষও একাত্ম হবে। পুলিশের দাবিদাওয়ার বিষয়গুলো যুক্তিসঙ্গত। এজন্য আলোচনা এবং সবার মত নেওয়াও জরুরি। এ দাবিদাওয়া মেটানো সরকারের পক্ষে কঠিন কিছু হবে না। সময়ের চাহিদার নিরিখে এ সংস্কার করতেই হবে। পুলিশের পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে যে দাবি রয়েছে সেগুলোকে শুধীসমাজও স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য স্বচ্ছ অবস্থান জনআস্থা ফেরানোর ক্ষেত্রে সহায়ক।

পুলিশের নিরাপত্তা ও কাজ করার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এ কাজটি পুলিশ সদস্যরা চাইলে নিজেরাই করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পুলিশবাহিনীর প্রতিটি সদস্য আইনানুগ পন্থায় চলবেন এবং যেটা আইনানুগ সেটাই করবেন। পুলিশ জনগণের বন্ধু এটি তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে এখন নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিষয়ে লক্ষ রাখা দরকার। আমরা জানি, রাজনীতিবিদরা পুলিশের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে কাজ করেন। রাজনীতিবিদদের এখন বুঝতে হবে, দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের বাইরে এসে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ভাবনা জরুরি।

পরিবর্তনের এ প্রেক্ষাপটে তাদের অর্থাৎ রাজনীতিকদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, পুলিশবাহিনী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট কোনো সরকারকে সেবা দেওয়ার জন্য গঠিত হয়নি। পুলিশ আপামর জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে। অতএব পুলিশকে আইনানুগ পদ্ধতিতে পরিচালনা করার বিষয়টি আমল নিতে হবে। পুলিশ কারও গৃহভৃত্য নয়। পুলিশ জনগণের বন্ধু এবং তাদের কাজও হতে হবে তেমন। পুলিশকে যেন কোনো পক্ষই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করলেই পুলিশের বড় সংস্কার সাধিত হবে বলে মনে করি। ইতোমধ্যে পুলিশে বেশ রদবদল আনা হয়েছে। তবে রদবদলই শেষ কথা নয়, পেশাগত অঙ্গীকারই হলো মূল কথা। যারা রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে কদাচারের ছায়া ফেলবেন তারা জনগণের মিত্র নন, হতে পারেন না।

  • পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি)
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা