সংঘাত-সহিংসতা
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৫১ পিএম
ড. ফরিদুল আলম
কোটা সংস্কার
আন্দোলন ঘিরে দেশ এক চরম অস্থির সময় অতিক্রম করছে। ছাত্রসমাজের ন্যায়সঙ্গত এ দাবি সময়মতো
মেনে নিলে জাতিকে আজ এমনটি দেখতে হতো না। দেশের মানুষের এটা খুব ভালো করেই জানা যে,
ছাত্রসমাজ যখন কোনো দাবিতে রাস্তায় নামে, তারা এর ফল না নিয়ে ঘরে ফেরে না। অবাক লাগে
বিষয়টা কেন বুঝতে পারল না সরকার। কিছু দায়িত্বহীন কথা আর কাজের জন্য আজ অন্য এক বাংলাদেশকে
দেখছে সারা দুনিয়া। বিশ্বগণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশ নিয়ে যেসব সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে,
প্রতিটিই আন্দোলনকারীদের পক্ষে এবং সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। কোটা সংস্কারের বিষয়টি
একটা পরিণতি পেলেও পরিস্থিতি অন্য এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে এ আন্দোলন দমাতে
সরকারের নীতিসমূহ ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছজ। এর নৈতিক এবং আইনি দিকগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ
হচ্ছে। নিহত ছাত্রদের রেশ যেন এক দুর্বার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে
আন্তর্জাতিক সমাজের ভূমিকাও অনেকটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকদের ডেকে কয়েক দফা ব্রিফিং করা হয়েছে।
সেখানে শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আন্দোলন ঘিরে যে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে এর জন্য
তৃতীয় পক্ষের উস্কানির বিষয়ে তাদের জানানো হয়েছে। সর্বশেষ ১ আগস্ট জাতিসংঘ, ইউরোপীয়
ইউনিয়নসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত ২২ দেশের কূটনীতিককে ডেকে সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিফিংকালে
জানানো হয়েছে, এ আন্দোলনে হতাহতের ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এর
পরিধি বাড়ানো হয়েছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও দুজন সদস্য এবং তাদের ৪৫ দিনের মধ্যে
প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে হতাহতের তদন্ত বিষয়ে সরকারের
অবস্থান জানতে চাওয়া হয় এবং এর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও এর আলোকে যথাযথ ব্যবস্থার প্রতি
গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যে নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সরকারকে
সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং জানা যায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের
একটি টিম এ ক্ষেত্রে প্রস্তুত রয়েছে।
কূটনীতিকদের কেউ
কেউ এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিবের পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে এর
প্রয়োজন নেই এবং ভবিষ্যতে তদন্তের স্বার্থে কোনো কারিগরি সহযোগিতার প্রয়োজন হলে কূটনীতিকদের
জানানো হবে বলে অবহিত করা হয়। সরকারের জন্য এ মুহূর্তে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে
হলে জাতিসংঘের প্রস্তাবটি বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কোনো রাষ্ট্র নয়, যেখানে
জাতিসংঘ রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে গঠিত একটি অতিরাষ্ট্রীয় সংগঠন, সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের
সম্পৃক্ততার সঙ্গে আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্নের কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও এ তদন্ত কমিশনে
যারা রয়েছেন তারা সবাই মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, তার পরও জনগণের পালস্ বিবেচনায়
সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি উপলব্ধি করানোর জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবটি আমলে নেওয়া শ্রেয়
মনে করি।
এ আন্দোলন ঘিরে
দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, এর পরিণাম আগামী দিনগুলোর জন্য আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি
ডেকে আনতে পারে। এক মাস ধরে অর্থনীতির চাকা অনেকটাই থমকে আছে, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের
প্রবাহ স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে আমাদের রিজার্ভের
ওপর আরও চাপ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের
আস্থার সংকট এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নতুন বিনিয়োগকারীরা তাদের সম্ভাব্য বিনিয়োগ
নিয়ে দ্বিধার মধ্যে আছেন। পরিস্থিতির যত দ্রুত উত্তরণ ঘটবে, তত দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর
চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। অতীতে এমনও অনেক দেখা গেছে, দেশের মানুষ যেকোনো দুঃসময় কাটিয়ে
উঠে আরও অধিক পরিশ্রম করে সমস্যা জয় করেছে। তার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক পরস্পরনির্ভরতার এ সময়ে এসে আমাদের নিজেদের
কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের দিকে যেতে হলে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়াতে হয়। সেই সঙ্গে এ সম্পর্ক
টিকিয়ে রাখতে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হয়।
বিগত সময়গুলোয়
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন
ঘটেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ২০.৭ ভাগ ছিল ২৭ জাতির এ জোটের সঙ্গে। গত
বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইইউ এ কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নিতে নতুন অংশীদারি
এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হয়। এ লক্ষ্যে আগামী মাসে ইইউর পক্ষ থেকে
একটি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল, যা তাদের পক্ষ থেকে স্থগিত করা হয়েছে চলমান
অস্থির পরিস্থিতির কারণে। এ সময়ে এসে এও আমাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। ইইউ বাংলাদেশকে
বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে থাকে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইইউর বিদেশনীতি প্রধান
জোসেফ বোরেল জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনে সব হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং
সে অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সুতরাং পরিস্থিতিকে হালকা করে
দেখার অবকাশ নেই। এদিকে ২ আগস্ট জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে
৩২ শিশু নিহতের তথ্য জানানো হয়েছে এবং হতাহতের প্রভাব থেকে শিশুদের বের করে এনে তাদের
নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা, স্কুলগুলো খুলে দেওয়া এবং শিক্ষাজীবন নিশ্চিতের পরামর্শ দেওয়া
হয়েছে।
আন্দোলনের একপর্যায়ে
১৬ জুলাই যখন প্রথম ছয় ছাত্র নিহত হয় এবং এর জেরে সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড
সংঘটিত হয়, এর দায় সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় পক্ষের ওপর দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশের
সচেতন মানুষের কোনো দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও একটি বিষয়ই ঘুরেফিরে আসছে,
আজ এ তৃতীয় পক্ষের উত্থানের পেছনেও কি সরকারের নীতি দায়ী নয়? কই, যারা এখনও রাস্তায়
অবস্থান করছে এবং প্রতি মুহূর্তে এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, তাদের সবার মনে এ ধ্বংসের
ক্ষতের চেয়েও সাধারণ ছাত্রদের হারানোর ক্ষত অনেক বেশি দগদগে হয়ে আছে। আজ তাই সবার আগে
এ প্রশ্ন উঠেছেÑসরকার যথাসময়ে যথাযথ কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসবের জেরেই কোটা সংস্কারের
একটি আপাত সমাধান হলেও নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক কিছু। এ সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য
সরকারের তরফে যে রাজনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করা উচিত, এর প্রয়োগের অভাব অনেক বেশি দুশ্চিন্তার
কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে নিহতের প্রতিবাদে দেশের সচেতন মানুষ রাজপথে নেমেছে, এমন
অবস্থায়ও যখন সরকারপন্থি ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা এবং বিভিন্ন জায়গায় পাল্টা হামলার ঘটনা
ঘটছে তখন সরকারের ভাবমূর্তি আরও খারাপ হচ্ছে।
১ আগস্ট জামায়াতে
ইসলামী-ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করে গ্যাজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
এ গ্যাজেটেরে একাংশে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধের সপক্ষে সাম্প্রতিক সহিংসতায় তাদের ইন্ধন
রয়েছে বলে সরকার জানিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড আমরা কিভাবে বিশ্লেষণ
করব? জামায়াত-শিবিরকে তো আমরা জানিই। আজকের এ আন্দোলনের পেছনের শুরুটাও কি ছাত্রলীগ
করেনি? যদি তারা ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে মাঠে নৈরাজ্য সৃষ্টি না করত তাহলে
এ আন্দোলন আজকের অবস্থায় আসত না। একটি দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন
তাদের সর্বাগ্রে সবচেয়ে বেশি যে গুণটা থাকতে হবে তা হচ্ছে ধৈর্যশীল আচরণ। সাম্প্রতিক
সময়ে সরকারের মধ্যে এর অভাবটি খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে। সরকার একটি সত্তা, এর প্রধান
একজন থাকলেও তিনি কিছু বিশ্বস্ত মানুষকে পাশে নিয়ে দেশ পরিচালনা করেন। আমরা আজ যা দেখতে
পাচ্ছি, তা হলো এ বিশ্বস্ত মানুষগুলো, যারা তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে
যাচ্ছেন, এর মধ্যে একটিও সৎ পরামর্শ নেই, যা সংকট উত্তরণে সহায়ক হতে পারে। এখন প্রশ্ন
উঠতে পারেÑতাহলে করণীয় কী? এর জবাব অনেকটাই ১৪ দলের নেতাদের কেউ কেউ দিয়েছেন, যার মধ্যে
একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একজন নেতা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, দাবা খেলায় অনেক সময়
রাজাকে বাঁচতে হলে মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া বিসর্জন দিতে হয়। মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর এ বিসর্জনের
কাজটি অনেক আগেই বিশেষ করে ১৬ জুলাই যখন প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটে তখনই করা দরকার ছিল।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেও আন্দোলনকারীরা তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেনি। ছাত্রদের এবং সর্বস্তরের আন্দোলনের ভাষাটি বুঝতে হবে। সরকার এবং দলের ভেতর দ্রুত কিছু গ্রহণযোগ্য সংস্কার এনে ছাত্রদের নয় দফার যৌক্তিক দাবিগুলো সরকার পূরণ করেছে, এ মর্মে একটি বার্তা দেওয়া ভীষণ দরকার। এও মনে রাখা দরকার যে, আলোচনার সময় যখন অতিক্রান্ত হয়ে যায় পরিস্থিতি তখন ঘোলাটে হয়ে যায়। বর্তমানে এমনই এক ঘোলাটে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।