সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১০:২১ এএম
সন্ত্রাসবিরোধী
আইনের ১৮(১) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের
অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। সরকারের এই উদ্যোগকে
আমরা সাধুবাদ জানাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলো
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সরাসরি সহযোগিতা করার পাশাপাশি গণহত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগ
ইতোমধ্যে প্রমাণিত। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (বাংলাদেশ) জামায়াতে
ইসলামীর অনেক শীর্ষ নেতা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন এবং তাদের অনেকের
চূড়ান্ত দণ্ডও ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এখনও
চলমান।
জামায়াত-শিবির
নিষিদ্ধ করে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ ধারণকারী দেশের মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন
ঘটিয়েছে। তবে আমরা মনে করি, কেবল নিষিদ্ধ করেই কর্তব্য শেষ নয়। তাদের সম্পদ ও সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের জন্য দলটির বিচারের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রসঙ্গটি আটকে আছে।
আমাদের স্মরণে আছে, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণার পর ‘গণজাগরণ
মঞ্চ’ নামে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের সুযোগ
রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭২-এর যে সংশোধনী আনা হয়, সেখানেও ব্যক্তির
পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগ রাখা হয়। তখন মানবতাবিরোধী অপরাধে একাধিক মামলায় জামায়াতকে
‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ আখ্যা দেওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মুক্তিযুদ্ধে দলটির
ভূমিকা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধনের
বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে।
মানবতাবিরোধী
কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার সাধুবাদ
কুড়িয়েছিল। আর এত দিন পর, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করায় দেশের প্রগতিশীল সব শক্তি গ্লানিমুক্ত
হয়েছেÑ এরকম প্রতিক্রিয়া নানা মহল থেকে উঠে এসেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তানের
পক্ষে কাজ করে জামায়াত ও তাদের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (পরবর্তীকালে
যার নাম হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে
রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে দল গঠন করে। হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, বাড়িঘরে
আগুন, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। ১৯৪১ সালে দলটি
গঠিত হওয়ার পর প্রথমবার নিষিদ্ধ হয় ১৯৫৯ সালে সাম্প্রতিক দাঙ্গায় উস্কানির অভিযোগে।
১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হয় মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করার কারণে। ১৯৭২
সালে তৃতীয়বার তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয় স্বাধীন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
নিষিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের
হত্যার পর ওই সালেই তৎকালীন শাসক জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতিতে ফের পুনর্বাসন করেন।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এর চার দিন পর হাইকোর্টের
রায় স্থগিত চেয়ে করা আপিল খারিজ হয় চেম্বার আদালতে। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর নিবন্ধন
অবৈধ ও বাতিলের রায় অব্যাহত রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
জামায়াত-শিবিরকে
নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং এরপর যদি কোনো আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন
হয়, তাহলে তাও দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। দল নিষিদ্ধ হলেও ছড়িয়ে পড়া
তাদের শেকড়-বাকড় উৎপাটনে সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মানবতাবিরোধী
অপরাধের দায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বিচার দাবি ইতঃপূর্বে নানা মহল থেকে উঠেছে।
এখনও এই দাবিতে বিভিন্ন মহল সোচ্চার। অনেকেই মনে করেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করলেও
তারা ভিন্ন কায়দায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক বলে আমরা মনে
করি না। এই প্রেক্ষাপটে শ্যেনদৃষ্টি রাখার পাশাপাশি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবিরের
সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলেও আমরা মনে করি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে
আমরা স্বাধীন দেশেও দেখেছি, রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে গুরুত্ব
দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মেরুকরণে তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনও করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় প্রত্যেকেই তাদের রাজনৈতিক বৈধতা কমবেশি
দিয়েছে। আমরা মনে করি, তাদের আজ আত্মজিজ্ঞাসার পাশাপাশি আত্মশোধনের প্রয়োজন। আমাদের
গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রাখতে হবেÑ এই নিষিদ্ধকরণ যেন কোনোভাবেই পরিবর্তন না হয়। এজন্য
এমন আইনি প্রক্রিয়া ও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দরকারÑ যাতে এই ভাবধারার আর
কোনো প্রতিফলন রাষ্ট্র ও সমাজে ঘটতে না পারে। একই সঙ্গে আমাদের আরও মনে রাখতে হবে,
শুধু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা
সহজ নয়। কারণ, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আরও আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারিক কার্যক্রম চলাকালেও দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনায়
বৃহত্তর নাগরিক সমাজ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সতত সোচ্চার। এ বিষয়ে
আইনমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে জামায়াত যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও
যুদ্ধাপরাধ করেছে সেই সময়ের দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচার করার ব্যাপারে সরকার
এখন উদ্যোগ নেবে। সেজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের
খসড়া চূড়ান্ত করার জন্যও তারা পদক্ষেপ নেবেন। আমাদের প্রত্যাশা, সরকারের এই প্রত্যয়
দ্রুত বাস্তবায়নের যেন উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত
এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীদের অধিকার ভোগের আশা করতে পারেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশে
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর একের পর এক
যে ঘটনা ঘটতে থাকে তা ইতিহাসের কদর্য অধ্যায়। এই প্রেক্ষাপটে আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে
চাই, নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেই দায় শেষ হয়েছেÑ এমনটি মনে করার কোনো
কারণ নেই। আইনের যে সংশোধনী না হওয়ায় দল হিসেবে জামায়াতে বিচার প্রক্রিয়া থেমে আছেÑ
এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে রাষ্ট্র শক্তিকে দ্রুত জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। অনেক দেরিতে
হলেও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে বটে,
তবে তারা যাতে আর কোনোভাবেই ফের তৎপরতা শুরু করতে না পারে সে অনুযায়ী সবকিছু নিশ্চিত
করতে হবে,