হানিয়া হত্যাকাণ্ড
ডেভিড হার্স্ট
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১০:১৭ এএম
ডেভিড হার্স্ট
হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানকে বড় বার্তা দিলেন। তিনি যে এই ভূখণ্ডে যুদ্ধ শুরু করতে চান, তা এখন স্পষ্ট। হানিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র হানিয়ার ওপর পরিচালিত ড্রোন হামলা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তা এখন স্পষ্ট। নেতানিয়াহু বরাবরই ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করে তার রাষ্ট্রকে নতুন পথে পরিচালনার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু এভাবে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইরানের সঙ্গে সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডকেও জড়িয়ে ফেলছে। এই হামলার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি সমঝোতার পথও তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি রাফায় সফরকালে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ফিলাডেলফিয়া করিডোরের দখল তারা নেবেনই। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, সমঝোতাকারী পক্ষের প্রধানকে হত্যা করার পর যুদ্ধবিরতি আলোচনা এখন কোনদিকে মোড় নেবে।
যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ
বাদ দেওয়া যাক। যুদ্ধবিরতি না হলেও হানিয়াকে জীবিত রাখা ইসরায়েলের স্বার্থেই জরুরি
ছিল। সমঝোতাকারী দলের প্রধানের অনুপস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি এখন বিলম্বিত হবে। হানিয়া কখনও
আত্মগোপনে থাকেননি। তিনি কাতারে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছেন এবং লুকানোর চিন্তা করেননি।
বরং শান্তি, সমঝোতা বিষয়ে বরাবরই তিনি আলোচনার কথা তুলেছেন। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এমন একজনকে হত্যা করার মাধ্যমে ইসরায়েল বিপাকে
পড়েছে। হানিয়াকে আপাদমস্তক কূটনীতিক বলেই অভিহিত করতে হবে। এই মুহূর্তে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
আর অন্যদিকে হানিয়া কাতারে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছেন। তারা কৌশলের স্বার্থে চাইলে
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ করতে পারতেন। সে পথে হাঁটেননি। তারা বেছে নিয়েছেন
গুপ্তহত্যার। এই মুহূর্তে হানিয়ার মৃত্যুতে হামাস আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে
তারা কোনোভাবেই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না। হামাস আবার
পুনর্গঠিত হবে এবং এখনও হচ্ছে। কারণ দীর্ঘ ১০ মাসেও হামাস পিছপা হয়নি। এখনও হবে না।
কৌশলগত আঙ্গিক
বিবেচনায় ইসরায়েল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কথাটি আমার নয়। ইসরায়েলি জেনারেল আমিরাম লেভিন
জানিয়েছেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীকে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।’ কাতারে হামাসের
ব্যুরোর একজন প্রধান স্বাধীনভাবে ঘুরছেন এ অজুহাতে তারা কাতারের ওপর চাপ তৈরি করতে
পারত। সেসব হিসাব এখন হিসাবের বাইরে। নেতানিয়াহু নিশ্চিত হতে পারেন, হামাস দুর্বল হয়নি।
হানিয়া জীবদ্দশায় যুদ্ধে তার পরিবারের ৬০ সদস্যকে হারিয়েছেন। এই সদস্যদের হামাসের শহীদ
হিসেবে আজীবন স্মরণ করা হবে। ইসরায়েল হামাসের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই আন্দোলন
ক্রমেই বাড়ছে। আর এই আন্দোলনের প্রতিবাদে তারা নিজেদের শক্তিমত্তা বাড়াচ্ছে এবং রাজনৈতিক
প্রভাব বিস্তার করছে। বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে নির্বাচন আয়োজন করা
হলে জয়ী হবে হামাস।
বিগত ১০ মাসে
হামাস ইসরায়েলের আক্রমণ প্রতিহত করে আসছে। তা ছাড়া হানিয়া হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের
লঙ্ঘনও বটে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সত্য জানে। হানিয়াকে হত্যা করা তাদের অপরাধের
পাল্লার শেষ অপরাধ। হামাসের শক্তিমত্তা বেড়েছে। তারা ভেঙে পড়েনি। বরং এভাবে গুপ্তহত্যায়
হামাসের নেতাকে হত্যা সংগঠনের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। হানিয়ার হত্যার দিনই ইসরায়েলের
কারাগারে এক ফিলিস্তিনি নারী ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য
উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দাবানলের মতো সংকট এগিয়ে আসছে ইসরায়েলের দিকে। সদে তেইমান কারাগার
থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকেই তাদের নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন। একজন জানিয়েছেন, সামরিক
বাহিনীর লোকদের বিনোদনের একটি স্থল হচ্ছে ডিস্কো রুম। এই ডিস্কো রুমে বন্দিদের মেঝেতে
নগ্ন করে বেঁধে রাখা হয়। তারপর তাদের অত্যাচার করে উল্লাস করা হয়। হাতকড়া এত শক্তভাবে
বেঁধে রাখা হয় যে, অনেকের হাত চিরজীবনের জন্য অকেজো হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের কারা
অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। কোনো কিছুরই তদন্ত হয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায়
যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তদন্ত করতে বলছেন। নেতানিয়াহুর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। শুধু
নেতানিয়াহু নয়, ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে বরং ইসরায়েল রাষ্ট্র বিপদের মুখে পড়েছে।
হানিয়াকে হত্যার পর হামাসের কাছে বন্দি ইসরায়েলিদের উদ্ধার করার কাজও এখন অনেকটাই বন্ধ।
ইসরায়েল হুতিদের সংঘবদ্ধতার কথাও জানে। লোহিত সাগরে তারা কতটা তৎপর এবং কীভাবে আক্রমণাত্মক
হয়ে উঠতে পারে, এ কথা তাদের ভালোই জানা। হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বেন গুইরন বিমানবন্দরে
হামলার হুমকি দিয়েছে। এসব হুমকি ফাপা বুলি নয়। ইসরায়েল তা ভালোই জানে। ইসরায়েলের সামরিক
কর্তারা এও জানেন, তাদের সেনাদের ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সচরাচর যে ভুল করে থাকে, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল একই ভুল করে চলেছে। তারা এখনও এক ধরনের ভ্রমের মধ্যে আছে। ইহুদিরা মনে করে, তারা ঈশ্বরের নির্বাচিত ব্যক্তি। এসবে আসলে তাদের কোনো দোষ নেই। ইসরায়েল ভাবতেই পারে তারা তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে। সামরিক শক্তির মাধ্যমে তারা নিজেদের জয়ের স্বপ্ন দেখছে। আর এজন্যই ইসরায়েল সবচেয়ে স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে তাদের সম্ভাবনা নষ্ট হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। বিক্ষোভের সময় তারা অ্যাংগোলার সরকার পতনের চেষ্টা করে। নামিবিয়ায় পুতুল সরকার গড়ে তোলে। জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা এবং জাম্বিয়ায় আঘাত হানে। এসব কৌশল কোনো কাজে আসেনি। বরং আফ্রিকা অঞ্চল ধসে পড়ে। নেতানিয়াহুও অনেকটা একই পথে এগিয়ে চলেছেন। নেতানিয়াহু আত্মতুষ্টির জন্যই এখন সব করছেন। এভাবে তার প্রাপ্তি আসলে কম। বরং হারানোর আছে অনেক কিছু।
মিডল ইস্ট
আই থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন