মৎস্যসম্পদ
ড. হারুন রশীদ
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪ ০৯:৪৮ এএম
ড. হারুন রশীদ
‘মাছ চাষে গড়বো দেশ বদলে দেবো বাংলাদেশ।’ কিন্তু মাছ চাষ করতে হলে তো জল বা জলাশয়ের
দরকার। জলই যদি না থাকে তাহলে মাছ থাকবে কোত্থেকে। জলের আধার হচ্ছে নদী-নালা ও খাল-বিল।
কিন্তু নদী দখল-দূষণে হারিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এখন
মাছ উৎপাদনে একটি বিপ্লব ঘটলেও তা হয়েছে নিছক বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা অনেকটা
‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’-এর মতো অবস্থা। কারণ বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হলেও
সেই মাছে বাঙালি রসনাতৃপ্ত হয় না। এ ছাড়া মাছের উৎপাদন বাড়লেও তাতে পুষ্টি চাহিদা মিটছে
না। এজন্য দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রাকৃতিকভাবেই যেন দেশি মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি
পায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আর মাছে-ভাতে বাঙালিকে প্রাকৃতিক মাছের অমৃতের স্বাদ
দিতে হলে নদী-নালা ও খাল-বিল বাঁচাতে হবে সবার আগে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে
৫৪ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ প্রায় বিলুপ্ত, ২৮ প্রজাতির মাছ চরম বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতির
মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালাশূন্য।
খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব।
পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক নদীর নাম হালদা। চট্টগ্রামের ব্যতিক্রমী এই নদীতেই মাছ
পূর্ণিমা-অমাবস্যার একটি বিশেষ সময়ে ডিম ছাড়ে। বহুসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ
হয় এই নদীকে কেন্দ্র করেই। নদীর পানিও ভূ-উপরিস্থ জলের আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শহরে
এই নদী থেকেই পানি শোধন করে তা পানের জন্য সরবরাহ করা হয়। অথচ দখল-দূষণে এই নদীও মৃতপ্রায়।
হালদা দখল করে হচ্ছে ইটভাটা, বসতবাড়ি। এটা এক আত্মঘাতী প্রবণতা। যেখান থেকে শত শত মণ
মাছের ডিম উৎপাদন হয়, সেখানে এখন মাছের এক মণ ডিম পাওয়াও দুষ্কর। এর ফলে মাছের অভাব
যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি নদীতীরবর্তী বহুসংখ্যক মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়ে মানবেতর
জীবনযাপন করছেন। এটা মনে রাখা দরকার, হালদা বাঁচলেই প্রাকৃতিক মাছের বিশাল এক ভান্ডার
রক্ষা পাবে। হালদা একটি বিশেষ ধরনের নদী। একে রক্ষা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। সুন্দরবন
যেমন অনন্য, আমাদের দেশকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরবে এর রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে। তেমনি হালদাও।
একটি সুন্দরবন যেমন সৃষ্টি করা সম্ভাবনা কৃত্রিমভাবে। তেমনি হালদাও। এই বিশিষ্টতার
মূল্য দিতে জানতে হবে। কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এগুলো বৃষ্টির
পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল, জলাশয়গুলোতে গিয়ে পড়ে এবং মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি
হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে
মাছ।
এ ছাড়া প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা, জাটকা নিধনের কারণে রুপালি ইলিশও বিলুপ্তির পথে।
ইলিশ রক্ষার বিষয়ে নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায় নানা সময়ে। ইলিশের ব্যবস্থাপনা নিয়ে
ইতোপূর্বে ‘আন্তঃসীমান্ত সংলাপ’ও হয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন
যে, ভারতের সঙ্গে কার্যকর সহযোগিতা ছাড়া ইলিশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ
ও ভারতের বেশকিছু অভিন্ন নদী রয়েছে। পদ্মাসহ বেশকিছু নদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত
হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। দুয়েকটি নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। সাধারণত স্রোতস্বিনী নদীতে ইলিশ বেশি থাকে। আর নদীতে স্রোত তো দূরের কথা, যদি
পর্যাপ্ত পানি না থাকে, তবে ইলিশ বাঁচবে কীভাবে? ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের
পদ্মাসহ কয়েকটি নদীর শীর্ণদশা। বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীতে পানি থাকে না। বাংলাদেশ-ভারতের
যৌথ উদ্যোগে ইলিশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ শুরু হলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব
হবে বলে আশা করা যায়। এই বর্ষা মৌসুমে বাজারে ইলিশের ছড়াছড়ি থাকার কথা থাকলেও সে তুলনায়
নেই।
এখানে-সেখানে বড় বড় চর পড়ে একদার প্রমত্তা পদ্মার মৃত্যু প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।
শুধু বর্ষাকালের তিন-চার মাস ছাড়া সারা বছর নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে। দেশের অন্য
নদীগুলোরও একই অবস্থা। তাহলে আমাদের প্রিয় মাছ ইলিশ কোথায় যাবে? কোথায় অবাধে তার বংশবৃদ্ধি
হবে? যেখানে ছোট জাটকা সহজেই বেড়ে একটি উপাদেয় ইলিশে পরিণত হবে? আসলে প্রায় দুই যুগ
ধরে যেন ইলিশের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ইলিশ
এক দিন বিলুপ্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই ইলিশবান্ধব একটি প্রতিবেশ তৈরির জন্য কার্যকর
পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু মৎস্যসম্পদ বিলুপ্ত হওয়াই
নয়, নদী দখল-দূষণের বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বিশেষ করে শিল্পকারখানার
আশপাশের এলাকার কৃষকরা এ নিয়ে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। বিষাক্ত পানির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে
আর্সেনিক, পচা জৈব উপাদান, দ্রবীভূত ও অদ্রবীভূত লবণ, সোডা, ক্ষতিকারক ক্রোমিয়াম; যা
জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অপরদিকে নদীদূষণও অব্যাহত
আছে। কিন্তু এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।
নদীদূষণ নিয়ে এত কথা, এত লেখালেখি, পরিবেশ সংগঠনগুলোর আন্দোলন এমনকি খোদ হাইকোর্টের
নির্দেশনা সত্ত্বেও তা বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকার পাশে চার নদীর দূষণ বন্ধে এ পর্যন্ত কম
পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কিন্তু দূষণ অব্যাহত আছে। বুড়িগঙ্গায় যাতে কেউ বর্জ্য ফেলতে না
পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
নদীদূষণ এখন শুধু নদীর পানিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, তা আশপাশের জনপদকেও করে তুলছে মারাত্মক দূষিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্য গিয়ে নদীর পানিদূষণ করছে। আর দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের আবাসিক এলাকা, আবাদি জমিতে। ফসলি জমি এমনভাবে নষ্ট হয়ে কালো হয়ে গেছে যে, তা খালি চোখেই দেখা যায়। এ ছাড়া মাটি পচে মারাত্মক দুর্গন্ধও ছড়ায় তা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েছেই, জমিতে ফসলও ফলছে না। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, এখনই এর একটা বিহিত করা দরকার। অভিযোগ রয়েছে, নদী ও আবাদি জমি দূষণের সঙ্গে জড়িত অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেই। বছরের পর বছর কোনো ইটিপি ছাড়াই তা চলছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে হবে যাতে অপরিশোধিত বর্জ্য কোনো অবস্থাতেই তারা ফেলতে না পারে। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় হতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালাতে হবে।