সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:৫৬ পিএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:৫৬ পিএম
আমাদের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপে ছিল। এর মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় আরও বাড়তি চাপ পড়ে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সবক্ষেত্রে এর অভিঘাত লাগে। আমরা জানি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্বস্তিরতা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি যে এর অনুকূলে নয় নানা ক্ষেত্রে এর সাক্ষ্য মিলছে। ২৫ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ এরই খণ্ড খণ্ড চিত্র উঠে এসেছে।
সহিংসতার এক পর্যায়ে সরকার বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি করলেও পর্যায়ক্রমে তা শিথিল হচ্ছে এবং শিল্পকারখানায় স্বল্প পরিসরে হলেও উৎপাদন শুরু হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি হওয়া শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাতসহ অন্য রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে তাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশিদের ক্রয়াদেশে হয়তো তাদের মূল্যছাড় দিতে হবে এবং কিছু পণ্য নিজেদের খরচে উড়োজাহাজে পাঠাতে হবে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ভিন্ন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিভিন্ন খাতভিত্তিক ব্যবসায়ীদের দৈনিক গড়ে ৪০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সীমিত ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের কারণে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। খোঁড়া পা গর্তে পড়লে যে অবস্থা হয় আমাদের অর্থনীতির অবস্থা বর্তমানে খানিকটা এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনা দুর্যোগ পরিস্থিতি-উত্তর দেশের অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস নিচ্ছিল, তখনই আবার আন্দোলনের কারণে এক্ষেত্রে অভিঘাত লাগতে থাকে। এক সমীক্ষায় প্রকাশ বিগত সপ্তাহে দৈনিক আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এই হিসাবের মধ্যে ডেটা সেন্টার, বিআরটিএ, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসযজ্ঞের আর্থিক হিসাব নেই এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রভাবে আনুষঙ্গিক আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবও নেই। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার অভিঘাত অর্থনীতিতে কতটা ব্যাপকভাবে পড়েছে খুব দ্রুত এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব কষা কঠিন। তা ছাড়া রপ্তানিমুখী কারখানা বন্ধ থাকায় দেশের যে ক্ষতি হয়েছে এর বর্ণনাও সংবাদমাধ্যমের পর্যবেক্ষণ ও ব্যবসায়ী মহলের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে।
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদার তৈরি পোশাক শিল্প খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতির বরাতে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, গত কয়েক দিনের স্থবিরতায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে বিজিএমইএর সরাসরি রপ্তানিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতির বরাতে সংবাদমাধ্যমেই বলা হয়েছে, এক দিন কারখানা বন্ধ থাকলে ১৬ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়; যা দেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। আমরা জানি, দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র খোলার জন্য এই প্রক্রিয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই। এই অবস্থায় আমরা মনে করি, ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবার দ্বার পুরোপুরি খুলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের বরাতে সংবাদমাধ্যমে এও বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। খণ্ড খণ্ড এই তথ্যের ভিত্তিতে অখণ্ড যে চিত্র উঠে আসে তাতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, অর্থনীতির সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র অত্যন্ত স্ফীত। আমরা মনে করি, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকল্পে সবাইকে সংযত হয়ে শান্তিপূর্ণ আবহ তৈরি করতে হবে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে। যে ক্ষতি হয়েছে এবং যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, এর উপশম এত সহজে হওয়ার নয়। চলমান বৈশ্বিক সংকটের বাইরে আমরাও নই এবং এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান পরিস্থিতির আরও বিরূপ প্রভাব যাতে দৃশ্যমান হয়ে না ওঠে, এজন্য স্বাভাবিক পরিবেশ ও সর্বস্তরে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান আমরা জানাই। সবার আাগে দেশ-জাতি। এমন কোনো আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে কারোরই জড়িত হওয়া উচিত নয় যার বিরূপ প্রতিফল সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে সড়কপথে কারফিউ শিথিলকালীন পরিবহন চলাচল করলেও মালবাহী ট্রেন ছাড়া যাত্রী পরিবহনের ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এগুলোর বিরূপ প্রভাবও কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতির ওপর পড়ছে। একই সঙ্গে আরও জরুরি হলো, অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে পরিমাপ করলেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতির পরিমাপ আর্থিক কাঠামোয় করা যায় না।
২৬ জুলাই সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা কয়েক দিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় এবং এটিএম বুথে টাকার স্বল্পতা একই সঙ্গে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর ২৪ জুলাই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিনেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এভাবে টাকা ধার দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ, তারপরও একসঙ্গে এত টাকা ধার দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরও আর্থিক চাপ বেড়েছে। ভিন্ন আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্য খালাসের চাপে চট্টগ্রাম বন্দরে জট সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় তার ৯৫ শতাংশই শুল্কায়ন করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, ২৪ জুলাই ৮ হাজার ১৫৩টি আমদানি-রপ্তানি চালান শুল্কায়ন হয়েছে। তারপরও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসেনি।
আমরা আশা করব, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে এবং জনমনে স্বস্তির আবহ সৃষ্টি হবে। আমরা আরও মনে করি, পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলে দিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে হবে। অর্থনীতি যদি গতিশীল না হয় এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা না যায়, তাহলে এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব সঙ্গতকারণেই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। অর্থনীতির ক্ষতি আর কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যায় না। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সব প্রক্রিয়ার পথই স্বাভাবিক করা বাঞ্ছনীয়। আমরা প্রত্যাশা করব জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।