প্রজন্মের ভাবনা
মরিয়ম সেতু
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:৫১ পিএম
আমাদের সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে জন্মগতভাবে যৌনপ্রতিবন্ধী হিসেবেই দেখা হয়। এ কথা সত্য, শারীরিক ত্রুটির কারণে মাতৃগর্ভে থাকা কিছু শিশুর পুরুষ বা স্ত্রী কোনো জননাঙ্গ সম্পূর্ণ গঠিত হয় না। একে আমরা যৌনাঙ্গ বিকলতা হিসেবে দেখতে পারি, তবে যৌনপ্রতিবন্ধী বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের লিঙ্গের অপূর্ণতা ছাড়া নারী ও পুরুষের অন্যান্য দৈহিক গঠনের পার্থক্য থাকে না। তৃতীয় লিঙ্গকে সমাজের প্রচলিত শব্দে হিজড়া বলে ডাকা হয়। হিজড়া শব্দটি মধ্যপ্রাচ্যীয়, ভারতবর্ষে এ শব্দের বহুল প্রচলন হয় মুঘল আমলে। মুঘলদের সময়ে এরা খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে গণ্য হতো। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মুঘল সম্রাটদের হেরেমের পাহারাদার নিযুক্ত হতো এবং সম্রাটদের সন্তান প্রতিপালনের দায়ভারও তাদের ওপরই ছিল। প্রাচীন মিসরেও এমন একটি শ্রেণির উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে তাদের খোজা করা হতো অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে তাদের যৌন বিকল করা হতো। এখনও অনেক মানুষ নানা কারণে যৌন বিকল হচ্ছে। আমরা তাদের যৌনপ্রতিবন্ধী বলতে পারি। তৃতীয় লিঙ্গের স্বতন্ত্র একটি পরিচয় আছে। বিষয়টি জুডিথ বাটলারের লিঙ্গবিষয়ক আলোচনা পড়লেই স্পষ্ট হওয়ার কথা।
অথচ আমাদের তৃতীয় লিঙ্গ হলো একটি মতবাদ যাতে এমন ব্যক্তিদের শ্রেণিভুক্ত করা হয় যারা পুরুষ বা নারী হিসেবে কোনোটায় স্বীকৃত নয়। যেহেতু তাদের এ বাহ্যিকতাকে ত্রুটি হিসেবে দেখা হয় তাই সমাজের নানা উপাদানই তাদের দমিয়ে রাখে। এ সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র এবং এমনকি তাদের পরিবার তাদের যেন অপরাধী হিসেবে দেখে। তাদের পরিবার, মা-বাবা সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি তো দূরের কথা সাধারণ যোগাযোগও রাখে না। জন্মগত ত্রুটির কারণে স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। যার কারণে তারা চরম মানসিক হীনম্মন্যতায় ভোগে। বাংলাদেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি ফরমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কোনো অপশন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাদের আমরা হিজড়া বলে চিহ্নিত করি।
আমরা এটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখি-বিভিন্ন যানবাহন, বাস, রাস্তাঘাটে হিজড়া সাধারণ মানুষদের হেনস্থা করছে। চাঁদা আদায় করছে। টাকা না দিতে চাইলে অশোভন আচরণ করছে, যা অনেক সাধারণ মানুষের কাছে খুবই লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ সমাজই তাদের বাধ্য করেছে এমন করতে। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগসুবিধার অভাব থাকায় তারা বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে এ পথ বেছে নিয়েছে। তবে ক্রমেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নানাভাবে নিজেকে মেলে ধরছে। তাদের জন্য নানাভাবে কাজ করা হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত বলা যাবে না। জুডিথ বাটলার লিঙ্গকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, সে অনুসারে একজন ব্যক্তি নিজেকে যে লিঙ্গ হিসেবে ভাবেন সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু যৌনাঙ্গ এবং বাহ্যিক রূপের ভিত্তিতে লিঙ্গপ্রতিবন্ধী বলা অবৈজ্ঞানিক তা-ও এখন অনেকটাই প্রমাণিত। একসময় বিষয়টিকে ত্রুটি ধরা হলেও এখন এ বিষয়ে ধারণার বদল কিছুটা হলেও আসতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকাংশই অবহেলিত। কিন্তু তারা আমাদের আশপাশেই বেঁচে আছেন। তাদের প্রতি আমাদের মনোভাবে বদল আনার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানোর বিকল্প নেই।
শিক্ষার্থী, সৈয়দ আশরাফ সরকারি পৌর মহিলা কলেজ, কিশোরগঞ্জ