সহিংসতা
ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:৩১ পিএম
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। অহিংস একটি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কীভাবে সহিংসতায় রূপ নিল এবং এর পরিণতিতে কী কী ঘটল এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা কম হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিদ্যমান সহিংস রূপ ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডসহ হতাহতের মর্মস্পর্শী সব ঘটনাই নিঃসন্দেহে বেদনাকাতর হওয়ার মতো বিষয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আর এর মধ্যে সীমিত যে থাকেনি তা-ও ইতোমধ্যে স্পষ্ট। কোটা সংস্কার প্রশ্নে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের খুব একটা মতপার্থক্য ছিল না। অনেকেই বলছেন, এর নিরসন আরও আগেই করা যেত এবং হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে সে সুযোগও ছিল।
কাউকে দোষারোপ না করে শুধু এটুকু বলতে চাই, শৃঙ্খলা ফিরুক, সংকট কাটুক। আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, এ রায়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি এবং সরকারও ইতোমধ্যে এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিপত্র জারি করেছে। কিন্তু সংকট যে পুরোপুরি কেটেছে তা এখনও সর্বাংশে বলা যাচ্ছে না। ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। একপর্যায়ে জারি করা হয় কারফিউ এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য দেশপ্রেমিক গর্বিত সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। পরিস্থিতি ইতোমধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে বটে এবং সেনা সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে নিষ্ঠার সাথে মাঠ পর্যায়ে দয়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু এ সত্যও অস্বীকার করা যাবে না, যে ক্ষত ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে উপশম হওয়ার নয়। অনেকেই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক রকম কথা বলছেন। অনেকেই সুপরামর্শ ও সুনীতির আলোকে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শও দিয়েছেন। নীতির কথা যেহেতু এলো সেহেতু স্কুলজীবনের কথা উল্লেখ করতে চাই।
স্কুলজীবনে যে কটি নীতিবাক্য আমাদের কোমল হৃদয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, তার অন্যতম হলো ‘দেশপ্রম ঈমানের অঙ্গ’। এরপর একে একে জেনেছি মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা কিংবা ক্ষুদিরামের কথা; তিতুমীর, হাজি শরিয়ত উল্লাহ কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বীরত্বের কথা। তখন অনেক বাসাবাড়ি, দোকান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতাসহ অনেক বীরের ছবি শোভা পেত। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল কিশোরবেলা থেকে দেশের প্রতি মমতা ও কর্তব্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠা।
একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত ইতিহাস ঠাঁই পেয়েছিল পাঠ্যপুস্তকে। কিন্তু সেসব দিনের অবসান ঘটেছে অনেক আগেই। এখন যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫, তারা সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগভক্ত শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের রচনা করা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছেন। তবে বিগত কয়েক দিন নানা কারণে দেশে যে তাণ্ডব ও নাশকতা ঘটেছে, তাতে দুঃখবোধ থেকে প্রশ্ন জেগেছেÑদেশপ্রেম শব্দটির সঙ্গে আদৌ কি পরিচিত এ বিপথগামীরা অর্থাৎ যারা এমন তাণ্ডব ও নাশকতায় অংশ নিয়েছে?
প্রতিটি সভ্য দেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা থাকে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, সঞ্চালনকেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিটিভি ও রেডিও সেন্টার, ইন্টারনেট হাব, ডেটা সেন্টার, পানির পাম্পসহ জনজীবনের জন্য জরুরি আমাদের সেসব কেন্দ্রকে ‘কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন’ (কেপিআই), ভালনারেবল পয়েন্ট (ভিপি), ‘নার্ভ সেন্টার’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। যুদ্ধকালে শত্রুর বা অন্য পক্ষের এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসের জন্য নিজ বাহিনীকে অভিযানে পাঠানো হয়। তবে আজকের বাংলাদেশে কে শত্রু কে মিত্র, কে নিজ বাহিনী, প্রশিক্ষণ দিল, কে ধ্বংস করল সেসব প্রশ্নের উত্তর মেলা কঠিন।
দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দিতে বর্তমান বিশ্বের ইন্টারনেট-ব্যবস্থার ধ্বংসসাধনই যথেষ্ট। সেই সঙ্গে সরকারি স্থাপনা, টোলপ্লাজা, অফিস-আদালত, মেট্রো স্টেশন, বেসরকারি কলকারখানা, চিকিৎসাকেন্দ্র, কিংবা দোকানপাট ধ্বংস ও লুট করা তাদের দ্বারাই সম্ভব, যাদের সাধ্যে দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই। তবে যারা এমন ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন তাদের সবাই দেশপ্রেম শব্দের সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত, তা ভাববার অবকাশ নেই। তাই ভাবতে হবে কারা, কেন, কীভাবে, একান্ত বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে কোমলমতি তরুণ-যুবকদের নিক্ষেপ করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার আর দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতীক একেকটি কারাগার। দেশ বা অন্যের ক্ষতিসাধন তথা অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে দোষীসাব্যস্তদের কারাগারে রেখে সংশোধন করা হয়। তাই কারাগারে হামলা ও ভাঙচুর করে যারা দাগিসহ ৮ শতাধিক আসামিকে বাইরে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন, তারা দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
একদিকে বাংলাদেশে যখন জেল থেকে কয়েদিরা পালিয়ে গেছে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে ৫৪ জন ১০ বছরের জন্য এবং তিনজন সারা জীবনের জন্য জেলে ঢুকছেন। দেশের অরাজক পরিস্থিতি কেন্দ্র করে বিদেশের মাটিতে বিক্ষোভ করায় এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে রাজতন্ত্র বা রাজপ্রথা চালু রয়েছে। সেখানে কোনো অবস্থায় কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বা সংহতির উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হওয়া বড় ধরনের অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ফলে দেশের আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজতন্ত্রের দেশে শোডাউনের বলি হলো ৫৭ মধ্যপ্রাচ্যনিবাসী প্রবাসী বাংলাদেশি। ভালোভাবে খবর নিলে দেখা যাবে তাদের মাঝে অনেকেই অতিশয় সহজ সরল শ্রমিক মাত্র। সবকিছু না জেনে ও না বুঝে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে রাস্তায় জমায়েত হয়েছিল এবং কখন কী হয়ে গেল বোঝার আগেই তাদের স্থান হলো জেল। এ দায় এখন কেউই নেওয়ার মতো থাকবে না। অথচ বিদেশের মাটিতে প্রতিটি প্রবাসী বাংলাদেশের দূতসম। তারা সেসব দেশের রীতিনীতি মেনে চললেই দেশের সুনাম বাড়ে এবং আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। হতদরিদ্র শ্রমিকদের যারা জেলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ফেলেছে, তারা পক্ষান্তরে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। দেশপ্রেম থাকলে তা হওয়ার কথা ছিল না।
সার্বিক বিচারে বলা যায়, আজ সময় এসেছে ‘সবার আগে দেশ’Ñএ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার। বিগত দিনে যা কিছু ঘটেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারও এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। যে বয়সে আমাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, সে বয়সে কারা দেশে সন্ত্রাস করে, কেন করে, কার ইন্ধনে করে, কী করলে এমনটা করবে নাÑসব কিছু নিয়ে ভাবতে হবে সচেতন নাগরিকদের। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশের মানুষকে স্বস্তির আবহে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ঘটনা থেকে কে কী শিক্ষা নেবেন তা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকেই ভাবতে হবে। তবে সহিংসতা কারও জন্যই যে মঙ্গলজনক নয়, এটি তর্কাতীত বিষয়। সহিংসতার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ নয়। দেশের সিংহভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয়। অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ুক কিংবা চলুক তা শান্তিপ্রিয় কেউই প্রত্যাশা করেন না। আমাদের সমাজে বৈষম্য জিইয়ে আছে তা অসত্য কিছু নয়। কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অযৌক্তিক ছিল সচেতন অনেকেই এমনটি বলেননি। কিন্তু এ সুযোগে যারা অন্য পথ বেছে নিলেন তাদের ব্যাপারে সচেতন নাগরিকসমাজেরও ভাবা উচিত।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে অসদুদ্দেশ্যে যারা যুক্ত হয়েছিল তারা দেশ-জাতির মিত্র নয়। শিক্ষার্থীরা তো আমাদেরই সন্তান। শিক্ষার্থীসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জননিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয় তাহলে কারও জন্যই স্বস্তির হবে না। দেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপসহ এমনিতেই নানাবিধ সংকটে রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি তাতে আরও বৈরী প্রভাব ফেলেছে। আমাদের এখন একটাই দাবিÑসবার আগে দেশ, এ প্রত্যয় ধারণ করে শান্তির অন্বেষণে যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিক্ষার্থীরা কখনও যেন কারও ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত না হয় এ দায়িত্ব প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলন যে এত ব্যাপক সহিংসতায় রূপ নেবে এবং মর্মস্পর্শী ঘটনার ছায়া প্রলম্বিত করতে তা যেহেতু শান্তিপ্রিয় কারওই কাম্য ছিল না সেহেতু এ উপলব্ধি ধারণ করে দেশপ্রেম বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের নতুন করে দাঁড়াতে হবে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর