প্রশ্নপত্র ফাঁস
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৪ ১৭:৪০ পিএম
অতিসম্প্রতি সমাজমাধ্যমে নানানরকম ট্রলের শিকার হচ্ছিলেন কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাহসান খান। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে পিএসসির কয়েকজন কর্মকর্তা এবং গাড়িচালক আবেদ আলীর গ্রেপ্তারের পর এ সমালোচনা শুরু হয়। ট্রলের মূল টার্গেট তাহসানের মা ড. জিন্নাতুন নেসা তাহমিদা খাতুন, যিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন। গ্রেপ্তার গাড়িচালক আবেদ আলী পিএসসি চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ছিলেন, এ খবরের সূত্র ধরে বলা হচ্ছিল তিনি তাহসানের মায়ের ড্রাইভার ছিলেন। অথচ সত্যটি হলো, আবেদ আলী কখনোই ড. জে এন তাহমিদা খাতনের গাড়িচালক ছিলেন না। অপপ্রচারকারীরা এটাও বলল, ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় তাহসান পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। পরে পরীক্ষাটি বাতিল হয়ে যায়।
এসব অপপ্রচারের তাৎক্ষণিক কোনো জবাব না দিলেও কয়েক দিন পরে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন তাহসান। বলেন, আবেদ আলী কখনোই তার মায়ের গাড়িচালক ছিলেন না এবং তিনি বিসিএস পরীক্ষায় কখনও অংশগ্রহণই করেননি। ১১ জুলাই তাহসান গণমাধ্যমকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিষয়টা এমন হয়েছে যে কোনো তথ্য যাচাইবাছাই না করেই সেটা সব জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আর মানুষ সেটা বিশ্বাসও করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি যদি এটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করতাম তাহলে সবাই আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আসল ইস্যু চাপা পড়ে যাবে। প্রশ্নফাঁসের যে বিষয়টি নিয়ে এখন সবাই কথা বলছেন এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত সেসব নিয়ে যে কথাগুলো হচ্ছে, সেটা ঘুরে আমার দিকে চলে আসবে। এটাই হয়তো কিছু মানুষ চেয়েছে। খুঁজে বের করা দরকার এগুলো আসলে কারা করছে।’ (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১২ জুলাই, ২০২৪)।
‘হুজুগে বাঙালি’ বলে আমাদের সুনাম রয়েছে। কেউ কিছু একটা বললে তার সত্যতা যাচাই না করেই সেটা নিয়ে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আবেদ আলী পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়ি চালাতেন এটা যেমন সত্য, তেমন তিনি কখনোই জে এন তাহমিদা খাতুনের গাড়ি চালাননি, সেটাও একশ শতাংশ সত্য। অথচ সেসব ভালোভাবে যাচাই না করে প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারিতে তাহমিদা খাতুনকে জড়ানোর বদমতলবে কতিপয় লোক বলে বসল আবেদ আলী তার গাড়িচালক ছিলেন। এমনকি যে ছেলেটি জীবনে কখনোই বিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, তাকে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ফার্স্ট বানিয়ে দিল! একশ্রেণির মানুষের কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করে পারা যায় না।
তাহসানের মা ড. জে এন তাহমিদা খাতুন যখন পিএসসির চেয়ারম্যান আমি তখন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। কাজের সুবাদে দুয়েকবার তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাহমিদা খাতুনকে সৎ এবং নিষ্ঠাবান হিসেবেই জানতাম। এ জানা আরও দৃঢ় হয় একটি ঘটনায়। তখন আমার পরিচিত এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি তার শ্যালককে বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় নির্বাচিত করার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। জবাবে তাহমিদা খাতুন তাকে বলেন, ‘নির্বাচিত না হওয়া ব্যক্তিকে নির্বাচিত করব কি না মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমার জানতে হবে।’ এরপর ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তি চুপসে যান। তাহসান দেশের একজন স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী এবং অভিনেতা। বিক্রমপুরের ছেলে হিসেবে তাকে নিয়ে আমরা অহংকার করি। যদিও আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎপরিচয় নেই, তবে একই এলাকার ছেলে হিসেবে তাকে ভালোভাবেই চিনি। আমার ও তাহসানের গ্রামের বাড়ি একই ইউনিয়নে। শ্রীনগর উপজেলার পাটাভোগ ইউনিয়ন। আমার গ্রামের নাম মাশুরগাঁও, তাহসানের গ্রাম মুশুরীপাড়া (স্থানীয় ভাষায় মুরুপাড়া)। তা ছাড়া আমার ছেলে মিউজিক কম্পোজার ইশতিয়াক সুলতান মেননের সঙ্গে তার অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। তাহসান একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। তার বাবা সানাউর রহমান খান ছিলেন প্রকৌশলী। তাহসান লেখাপড়া শেষে করপোরেট জব শুরু করেছিলেন। কিন্তু সংগীত এবং নাটকের মতো সৃজনশীল কাজের টানে অল্প দিন পরই তা ছেড়ে পুরোপুরি সংগীত সাধনায় নিমগ্ন হন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাহসান। তা না হলে আমরা আজকের তাহসানকে হয়তো পেতাম না।
বিসিএসের প্রশ্ন কেলেঙ্কারির ঘটনায় তাহসান ও তার মাকে জড়ানোর এ অপচেষ্টায় আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষের নেতিবাচক প্রবণতার উন্মোচন হয়েছে। দেশের বড় বড় রুই-কাতলার ‘সমুদ্র চুরি’র মতো দুর্নীতির খবর জানতে জানতে উচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী কেউ কেউ যে সৎ থাকতে পারেন, তা যেন আমরা ভুলতে বসেছি। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, রাজস্বের মতিউর রহমান, আরজিনা খাতুন, কাস্টমস কর্মকর্তা এনামুল হকের কীর্তিকাহিনী শুনতে শুনতে আমরা ভুলতে বসেছি ড. আকবর আলি খান, ড. সা’দত হুসাইন, আইজিপি আবদুর রকীব খন্দকার, গভর্নর ফরাসউদ্দিন আহমেদ, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহীম খালেদের নাম। তারাসহ বহুসংখ্যক উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা ছিলেন, যারা কর্মজীবনে সৎ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল এবং নিজেদের সবরকম দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘সক্ষম হয়েছিলেন’ বললাম এজন্য যে, অনেকে সৎ থাকার চেষ্টা করেও পারিপার্শ্বিক নানা চাপে থাকতে পারেন না। নিজের অজান্তেই কখন যে দুর্নীতির পাঁকে জড়িয়ে পড়েন টের পান না। এঁরা অবশ্য দুর্বল চিত্তের হয়ে থাকেন। অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস রাখেন না। কিন্তু কেউ কেউ পারেন। যারা পারেন, মানুষ তাদের স্মরণে রাখে। দুটি কর্মগুণে মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। একটি সুকর্ম, আরেকটি দুষ্কর্ম। যারা জীবনে সুকর্ম করেন, মানুষ তাদের স্মরণ করে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে। আর যারা দুষ্কর্মের দ্বারা নিজেদের পঙ্কিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করে, তাদের নামটি উচ্চারিত হয় সঘৃণায়।
কথা হলো, বিসিএসের প্রশ্ন কেলেঙ্কারিতে শিল্পী তাহসানকে জড়ানোর এ অপচেষ্টা কেন? যদিও তাহসান এ সম্পর্কে কিছু বলেননি, হয়তো বলবেনও না। তার পরও অনুমান করা যায়, শিল্পী হিসেবে তার উত্থানে ঈর্ষাকাতর কোনো ব্যক্তি বা মহল এ কাজটি করে থাকতে পারে। তাই তারা আবেদ আলী তাহমিদা খাতুনের ড্রাইভার ছিলেন কি না, তাহসান কখনও বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন কি না, সেসব তলিয়ে দেখার গরজ অনুভব করেননি। সত্যাসত্য যাচাই না করেই ছড়িয়ে দিয়েছেন উদ্ভট গল্প। কেউ কেউ সে গল্প বিশ্বাসও করতে শুরু করেছিলেন। সমস্যাটা এখানেই। অপপ্রচার একজন ভালো মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করে। গণমাধ্যমে তাহসানের বক্তব্যের পর এ বিষয়ে সৃষ্ট সব বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক