× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আপিল বিভাগের রায়

স্বস্তি ফিরুক, শান্তি আসুক

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৪ ১৭:৩৫ পিএম

স্বস্তি ফিরুক, শান্তি আসুক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অহিংসই ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং ক্রমান্বয়ে মর্মস্পর্শী চিত্র দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে আগাম বেঞ্চ বসিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আপিলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। এ প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয় একটু ভেবে দেখা দরকার। ২১ জুলাই আদালত যে রায়টি দিলেন, তা আরও আগে দিলেই মনে হয় ভালো হতো। মনে করি, তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি এতটা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠত না। কোনো কোনো মহল এ বিলম্বের সুযোগ নিয়েছে। সব দিক থেকে আগাম ব্যবস্থা নিলে কিংবা কালক্ষেপণ না করলে সুযোগসন্ধানী মহল এ সুযোগটি নিতে পারত না। তার পরও আদালতের রায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাধানের একটি পথ তৈরি হলো। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারের একটি পরিপত্রে নবম গ্রেডে এবং দশম থেকে তেরতম গ্রেডের পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয় এবং বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়।

আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখি এ পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রুল জারি করেন পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে। সরকার রুলের জবাব দেওয়ার পর ৫ জুন শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে কোটা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের আদেশের পর কোটা বাতিল ও সংস্কার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষার্থী যুক্ত হন এবং আন্দোলনটা প্রায় দেশব্যাপী গড়ে ওঠে।

আগেই বলেছি, এ আন্দোলনের সুযোগে কয়েকটি রাজনৈতিক পক্ষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত রায় শিক্ষার্থী কিংবা আন্দোলনকারীদের দাবির কাছাকাছি প্রতিফলন ঘটেছে এমনটি বলা যায়। কাছাকাছি বলছি এ কারণে, কারণ তারা হয়তো ৯৫ শতাংশ চেয়েছিলেন। আদালতের এ রায় স্বস্তি জুগিয়েছে। সরকারের প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন চলমান। আদালত আদেশে বলেছেন, সরকার যেন প্রজ্ঞাপন জারি করে। হাইকোর্ট যেদিন রায় দিয়েছেন, তার পরদিনই যদি চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রক্রিয়া শুরু হতো তাহলে বোধহয় আন্দোলনের অধ্যায়টি এত মর্মস্পর্শী হতো না। তবে যেটা বলা হয়, ‘লেট বেটার দ্যান নেভার’। আপিল বিভাগ আর্টিকেল ১০৪ সামনে রেখে দেওয়া রায়ে বলেছেন, ৯৩ ভাগ মেধার ভিত্তিতে, ৫ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১ ভাগ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ এবং ১ ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য। এর জন্য সময় দেওয়া হয়েছে তিন মাস। তবে আমি মনে করি, এটা যত দ্রুত করা যায়, ততই মঙ্গল। সরকারি চাকরির কোটা মামলায় আপিল বিভাগের রায় ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা রাখার নির্দেশনাবিষয়ক পরিপত্র ‘যথা শিগগিরই’ জারি করা হবে।

আবারও বলি, এ প্রক্রিয়া যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে যে বিলম্ব হয় সে বিলম্ব থেকে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা সংকটে রূপ নেয়। এ সংকট পুঁজি করে সুযোগসন্ধানী মহল সুযোগ নিয়ে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন দ্রুত দেখতে চাইবেন। ২১ জুলাই দেওয়া এ রায়ের মাধ্যমে পুরো বিষয়টি একটি ভালো পর্যায়ে এলো বলা যায়। এ আন্দোলন কেন্দ্র করে পুরো বিষয়টি কেন এত দূর গড়াল হয়তো সরকারের উপলব্ধিতে নতুনভাবে এ বিষয়টিও আসবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়গুলো ভালো করে খতিয়ে দেখা দরকার। ভবিষ্যতের স্বার্থেই তা করতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে একটি অহিংস আন্দোলন সহিংস করার পরিণতি কারও জন্যই ভালো হয়নি। অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে এর উপশম সহজ হবে না।

হাইকোর্টের রায় থেকে শুরু করে আপিল বিভাগে বিষয়টি গড়ানো পর্যন্ত বেশ কিছু কর্মকাণ্ড ঘটেছে যেগুলো না ঘটলেই মনে হয় ভালো হতো। সরকারি দল নিজেই যদি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলত, আমরাও কোটা সংস্কার চাচ্ছি তাহলে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর তা বড় একটি মাইলেজ পেত। সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের অনেক কর্মী এবং নেতা এ আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে দল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার পরও ক্ষমতাসীন দলের কাছে সেটা পরিষ্কার ছিল না। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেকোনো আন্দোলন রাজনীতিকীকরণের অপচেষ্টা করা হয় এবং এ আন্দোলনেও তা অনেকটাই স্পষ্ট। সরকার তো প্রথম থেকেই বলে আসছে আমরা সংস্কারের পক্ষে। তাহলে হাইকোর্টের রায়ের পর এর অনুকূলে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিল না কেনÑএটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে যে কথা বলা হয় তাতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল। তারা তো সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু তা না করে সরকারের কেউ কেউ দায়িত্বহীন বক্তব্য দিয়ে বিষয়টি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছেন। এর ফলে আন্দোলনকারীদের সন্দেহ বাড়ে, অন্যদিকে সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক মহল সুযোগ নেওয়ার অবকাশ পায়। সরকারের এ বিষয়টি থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। কিছু কিছু বিষয় আছে, সার্বিক স্বার্থ কিংবা প্রয়োজনেই ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিতে হয়।

এ ঘটনা থেকে সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে, যেকোনো প্রক্রিয়ায় অহেতুক সময় ক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই। এ আন্দোলনে হতাহতের যে ঘটনা ঘটল, যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রোষানলে পড়ল এবং এ প্রেক্ষাপটে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র স্ফীত হয়ে উঠল এ সবই দেশ-জাতির জন্য অকল্যাণ ছাড়া আর কিছু নয়। শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতন যারা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্তক্রমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আমার আরও মনে হয় পুরো বিষয়টি নিয়েই গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার মর্মন্তুদ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট কীভাবে সৃষ্টি হলো, কেন সৃষ্টি হলো, কারা সৃষ্টি করল। আমার মনে হয় এ কারণগুলোও ভবিষ্যতের প্রয়োজনেই অনুসন্ধান করা দরকার।

শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ দ্রুত নিশ্চিত হোক এবং যারা হতাহত হয়েছেন সুষ্ঠু তদন্তক্রমে প্রতিটি ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। ইতোমধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন কাজ শুরু করেছেন। আমরা দেখছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির চেয়েও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি অনেক বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শিক্ষকদের যেমন দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার তেমন ছাত্ররাজনীতিরও সংস্কার প্রয়োজন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বিষয়ে নানা নেতিবাচক কথা বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসছে। ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য গৌরবোজ্জ্বল। স্বাধীনতার পূর্বাপর অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। কিন্তু সেখানে আজ ক্ষয় ধরেছে কেন? আমার মনে হয় এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানক্রমে যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করা উচিত।

ছাত্র সংগঠন কোনো রাজনৈতিক দলের ফোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। ‍সংবাদমাধ্যম সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি কীভাবে উপস্থাপন করেছে এও পর্যবেক্ষণের বিষয়। আমার ধারণা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের বোধ বা উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির মাশুল আর কত গুনতে হবে। ঘটনার বিশ্লেষণে বলা যায়, কোনো কোনো মহল হয়তো প্রস্তুতি নিয়েই সুযোগের অপেক্ষা করছিল এবং তারা সংঘবদ্ধও ছিল। এক একটি নাশকতার ঘটনায় এ বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আসে। আমরা দেখলাম থানা-কারাগার-রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়েছে। নরসিংদী কারাগার থেকে অস্ত্র লুট হয় এবং সহস্রাধিক কয়েদি পালিয়ে যায়; যার মধ্যে কয়েকজন জঙ্গিও ছিল বলে জেল কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমকে জানায়। এসব ঘটনা চরম উদ্বেগের পাশাপাশি আরও কিছু উপসর্গও সৃষ্টি করেছে। সব বিষয়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে খতিয়ে দেখা উচিত এবং সমস্যা-সংকট নিরসনে আলোচনাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

ভূরাজনৈতিক ও একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা বিদ্যমান যার ভেতর আমরাও বাস করছি। চলমান বৈশ্বিক সংকটের বাইরে আমরাও নই। এর মধ্যে সংঘটিত ঘটনাটি জনজীবনে ও সামাজিক ক্ষেত্রে অভিঘাত সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষতি স্ফীত করে চলেছে। এর বিরূপ প্রভাব বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। আমরা সব সময় মনে করি দৃশ্যত কিছু নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলাম এবং তাতেই সার্বিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়ে গেল। বিষয়টি কিন্তু সে রকম নয়। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যদি নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা না যায় তাহলে চূড়ান্ত অর্থে কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। চলমান কারফিউ যাতে দীর্ঘমেয়াদি না হয় এবং জনজীবনসহ শিক্ষাঙ্গনে যাতে দ্রুত স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসে এ বিষয়গুলোর দিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

লেখক : কূটনীতি-রাজনীতি বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা