সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪ ১১:১৮ এএম
৯ জুলাই ‘আস্থার চূড়া থেকে খাদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক’ শিরোনামে প্রতিদিনের
বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল তা মূলত দেশের বিশৃঙ্খল আর্থিক খাতের
বিদ্যমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ওই প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের মূলত চারটি
সংকটের কথা বলা হয়েছিল। সংকটগুলো হলোÑখেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, নিরাপত্তা সঞ্চয় ঘাটতি
ও আমানত পতন। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর ১৫ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদনেই উঠে
এসেছে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত আরেকটি ভিন্ন চিত্র। ‘কৌশলে খেলাপি ঋণ কমেছে সাড়ে ৬২ হাজার
কোটি টাকা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানামুখী কৌশল নিচ্ছে
ব্যাংক। অবলোপনের মাধ্যমে হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলার পাশাপাশি পুনঃতফসিল কৌশল কাজে
লাগানো হচ্ছে। আরও বলা হয়েছে, নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বিপুল সুদ মওকুফ করে ২০২৩
সালে মোটা অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। বছর জুড়ে সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি
ঋণ কমানো হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। ওই প্রতিবেদনেই জানা যায়, প্রার্থিতা বাঁচাতে গত জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের আগে ঋণ পুনঃতফসিলের হিড়িক পড়ে। এর ফলে তিন মাসে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি
টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করে ঋণ মুক্ত করা হয়।
আমরা মনে করি, কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর এই প্রক্রিয়া ব্যাংক খাতের
জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। এ খাতে বর্তমান যে নেতিবাচক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এর সিংহভাগই
মূলত খেলাপি ঋণ থেকে সৃষ্ট। সচেতন মানুষ মাত্রেই অজানা নয়, আমাদের অর্থনীতি তথা ব্যাংক
খাতের অন্যতম উপসর্গ খেলাপি ঋণ। ইতঃপূর্বে প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদনে এও উঠে
এসেছিলÑ খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক চিত্র কৌশলে ভালো দেখাচ্ছে। তখন এই
সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, ব্যাংকগুলোর এই কৌশল আত্মঘাতী ও অপকৌশলেরই নামান্তর।
এমন পরিস্থিতি আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ স্তর ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কোনোভাবেই
সুফল বয়ে আনবে বলে আমরা মনে করি না। কৌশলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখিয়ে মূল
সমস্যা অন্তরালে রেখে অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে, বিশ্লেষকদের এই অভিমতের
সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি না। মুখ্যত খেলাপি ঋণের কারণেই কিছু কিছু ব্যাংকের একত্রীকরণের
প্রসঙ্গটি আসে। কিন্তু দেখা গেছে, অনেক ভালো ব্যাংকই দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একত্রীকরণে
রাজি নয়। একই সঙ্গে এ কথা বলাও বাঞ্ছনীয়, যে গতিতে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে
একত্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তাতে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। ব্যাংক খাতের সুস্বাস্থ্যের
জন্য কৌশলে নয়, আসলেই খেলাপি ঋণ কমাতে হবে।
আমরা জানি, যেকোনো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ব্যাংক খাত।
এমনও বলা হয়, ব্যাংক খাত অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ফিরে ফিরে
নেতিবাচক অর্থে সংবাদমাধ্যমে এই খাতটির নানা অসঙ্গতিও উঠে আসছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ইতোমধ্যে
নানারকম আলোচনা-পর্যালোচনাক্রমে অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও কার্যত এর সুফল মেলেনি।
সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। এমতাবস্থায় ব্যাংক খাতে গ্রাহকের
আস্থার সংকটও দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদরা গত ফেব্রুয়ারি
মাসে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাত নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তাদের অনেকেই বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের জন্য অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে
এবং এ থেকে উত্তরণও সহজ নয়। তারা এও বলেছিলেন, খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংকের মূলধনই
চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। আলোচনায় এও উঠে এসেছিল, প্রভাবশালীদের সুবিধার্থে অনেক নীতি প্রণয়ন
ও ছাড় দেওয়া হয়Ñ যা পরবর্তীকালে আবার পরিবর্তনও করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে
ওঠার আগেই ফের নতুন ক্ষতির বার্তা এসে হাজির হয়।
লাগামহীন খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি, ডলার সংকট ও সাধারণ মানুষের
আস্থা ব্যাংকের ওপর থেকে কমে যাওয়া কোনোটাই প্রীতিকর বার্তা নয়। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি
মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো যেহেতু আশাব্যঞ্জক নয়, এমতাবস্থায় আমরা মনে
করি, ভারসাম্যপূর্ণ সুব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। নতুন করে খেলাপি ঋণের বোঝা যাতে
আরও স্ফীত না হয় এবং কৌশলের নামে কোনো অপকৌশলই যাতে ব্যাংক খাতে নতুন করে অভিঘাত সৃষ্টি
না করেÑ এ ব্যাপারে সতর্ক-সজাগ থাকার বাড়তি তাগিদ আমরা দিই। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট
অনেকটাই ব্যাংক খাত থেকে সৃষ্ট। এ খাতে সংস্কারের প্রশ্নে সব ধরনের প্রভাববলয় কীভাবে
মোকাবিলা করা হবে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকার কতটা দৃঢ় মনোভাব
দেখাতে সক্ষম হবেÑ এ বিষয়গুলো প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে সুশাসনের
কোনো বিকল্প নেই। ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ এই নীতির প্রতিপালনেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠা
করা সম্ভব। অনিয়মকারী কাউকেই যেমন ছাড় দেওয়া যাবে না, তেমনি প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে
কেউ যাতে নিজেরা ফায়দা লুটে না নেন সেদিকেও মনোযোগ গভীর করতে হবে।
আমাদের বিভিন্ন খাতে জবাবদিহির অনুশীলন হয় না। আমরা বিশ্বাস করি,
জবাবদিহি সংস্কৃতির অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যবস্থা পরিশীলিত করা সম্ভব। খেলাপি ঋণ নিয়ে
বছরের পর বছর আলোচনা হয়, বিতর্ক হয়; কিন্তু বিস্ময়কর হলো অজ্ঞাত কোনো কারণে খেলাপি
ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না কেনÑতা আমাদের বোধগম্য নয়। জাতীয় সংসদে এ ব্যাপারে
দফায় দফায় অনেক আলোচনা হয়েছে এবং ঋণখেলাপিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের দাবি জানানো
হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনো কিছুই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। ঋণখেলাপিরা কে কোথায়
আছেন, ঋণের বিপরীতে তারা যে সম্পদ বন্ধক রেখেছেন; আমরা মনে করি, এসবই খুঁজে বের করা
দরকার। ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশেরও অনেক নজির আছে। এই
প্রেক্ষাপটে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের অনমনীয় অবস্থান
ভিন্ন গত্যন্তর নেই। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পাশাপাশি
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও মন্দ ঋণের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কৌশলে খেলাপি
ঋণ কমিয়ে দেখানোর যে অপপ্রবণতার বার্তা সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে এর যথাযথ প্রতিবিধান
নিশ্চিত করা জরুরি। অপকৌশল কোনোভাবেই কোনো সুফল বয়ে আনবে নাÑ এই কথাটি দায়িত্বশীলরা
ভুলে না গেলেই মঙ্গল।