সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪ ১৪:২০ পিএম
প্রতি বছর বন্যা
আসে, বন্যা যায়। বন্যার আসা-যাওয়ার সঙ্গে নদীমাতৃক এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত। আমাদেরকে
প্রতি বছরই ঝড়, বন্যাসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সইতে হয়। দুর্যোগ মোকাবিলা করেই
দেশের মানুষ জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। প্রকৃতির রুদ্ররূপের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদেই
মানুষের মাঝে গড়ে উঠেছে অভ্যাস। ফলে বন্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপটাও তাদের জানা। পানিই
জীবন, কিন্তু সেই পানিই যখন বিপদের কারণ হয়ে ওঠে, তখন সেই বিরুদ্ধ স্রোতের বিপক্ষে
দাঁড়িয়েই সংগ্রামের দিকটাকে অভ্যাসে পরিণত করে বানভাসি মানুষ। অথচ আজকে বন্যায় অভ্যস্ত
মানুষের মাঝে প্রতিনিয়ত ভীতি বাড়ছে, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। কেন এই ভীতি, কেন এই
ক্ষয়ক্ষতি? এর পেছনে যত-না প্রাকৃতিক কারণ দায়ী, তারও বেশি দায়ী মানবসৃষ্ট কারণ। সাম্প্রতি
বন্যাসহ নানাধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে দায়ী করা হচ্ছে সরাসরি মানুষের নেতিবাচক
কর্মকাণ্ডকে। দায়ী করা হচ্ছে আমাদের অপরিণামদর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নদ-নদী দখল
ও তার গতিপথ পরিবর্তনকে। আর এসবই বাড়িয়ে তুলছে নতুন নতুন বিপদের আশঙ্কা।
১৩ জুলাই প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘বৃষ্টির তোড়ে অবরুদ্ধ ঢাকা’। বর্ষা মৌসুমে
তো বটেই বছরের অন্যান্য সময়েও বৃষ্টি প্রকৃতির স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। বাঙালির জীবনে ‘বৃষ্টিবিলাস’
স্মৃতিমেদুরতায় ভরা একটি সময়। বৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে বর্ষাযাপনও বাঙালিজীবনে
অনন্য দিক। অথচ প্রকৃতির এই স্বাভাবিক রূপটিই এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা
দেশে বৃষ্টি হয়েছে ২ হাজার ৫০৩ মিলিমিটার। আর এক দিনের এই বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা,
কক্সবাজার ও রাজশাহীতে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। গত শুক্রবারের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর
অনেক স্থানে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এতে দুর্ভোগে পড়ে মানুষ। বৃষ্টির পানিতে রাস্তাগুলো
জলমগ্ন হয়ে পড়ায় অনেক এলাকায় যানবাহন চলাচল করে ধীরগতিতে। আবার রাজধানীর কোনো কোনো
সড়কে যানবাহন চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ না পেয়ে
থইথই করতে থাকে, জলাবদ্ধতায় মহানগরজুড়ে সৃষ্টি হয় স্থবিরতা। ডুবে যায় রাজধানীর প্রধান
সড়কগুলোসহ অলিগলির পথগুলো।
রাজধানীর এই জলাবদ্ধতা
দূর করতে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগের কথাও জানা যায় প্রতিবেদন থেকে। যেখানে রাজধানীর
দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, জলাবদ্ধতা
নিরসনে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঢাকা উত্তর সিটিতে কাজ করছে পাাঁচ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
এ ছাড়াও সংস্থাটির দশটি অঞ্চলে দশজন কর্মীর সমন্বয়ে কাজ করছে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে কমলাপুর টিটিপাড়া পাম্প স্টেশনে পাঁচ হাজার কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন
দুটি বড় পাম্প ও পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ছোট পাম্প এবং ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনে
সাত দশমিক পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্প চালুর মাধ্যমে পানি অপসারণে কাজ করা
হয়। উভয় সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগের পরও রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ কম হয়নি। প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর ‘কী কারণে এমন দশা রাজধানীর’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আবহাওয়া
অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী ১২ জুলাই ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৩১ মিলিমিটার। এই
বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানীর কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের
বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, এলিফ্যান্ট রোড, মৎস্য ভবন, সেন্ট্রাল রোড, ধানমন্ডি-২৭
নম্বর সড়কসহ কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, পশ্চিম তেজতুরীবাজার, তেজকুনিপাড়া,
দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়াসহ মহাখালীর বড় অংশ। এবারের ভারিবর্ষণে একই অবস্থা তৈরি
হয় কক্সবাজার এবং রাজশাহী মহানগরীতেও। বৃষ্টির পানি থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। কেন?
কারণ বৃষ্টির পানির স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই। সেই পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। এখন
প্রশ্ন উঠতে পারে, কারা সে পথ রুদ্ধ করেছে? আমাদের সবার জানা সেই উত্তরটিই প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর কাছে দিয়েছেন, স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেছেন, ‘এত বছর ধরে আমরা যা যা
বলে এসেছি, সেই কারণগুলোর একটারও প্রতিকার হয়নি বলেই আবার এই অবস্থাটা হলো। এই অবস্থা
আরও প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় ৪০ থেকে ৪৩ শতাংশ বর্জ্য
সিটি করপোরেশন সংগ্রহই করতে পারে না। আর এসব বর্জ্য যায় নালা ও খালে।’ এজন্যই পরিস্থিতি
যেন দিনদিন আরও খারাপ না হয়ে ওঠে সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই
হবে নাÑ এ ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল তত্ত্বাবধায়ক
প্রকৌশলী (পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেছেন, ‘স্বল্পমেয়াদে জলাবদ্ধতা হয় এমন ১৬১টি স্থান
নির্ধারণ করেছি এবং ২৬টি স্থানে চলমান ও আরও ২৬টি কাজ আগামী অর্থবছরে করা হবে।’
আমরা জানি, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা থেকে ড্রেনেজ সিস্টেম দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা আজকের নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এ সমস্যার সঙ্গে নগরবাসীকে ঝুঝতে হচ্ছে। তাদের স্বস্তি দিতে নানা সময়ে নানা পরিকল্পনা যেমন গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও কম, অর্থ ও সময় ব্যয় হয়নি। কিন্তু নগরবাসী তার সুফল পায়নি। বরং দিনদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমরা কথা নয়, কাজ দেখতে চাই। আমাদের ঢাকা শহরকে রক্ষায় এবং পরিবেশবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই। এজন্য নগরীর ভেতরে দখল হয়ে যাওয়া সকল খাল বা জলাশয় উদ্ধার জরুরি। যেসব এলাকায় দখলে কমে এসেছে খালের প্রশস্ততা এবং পলিথিনসহ নানাবিধ বর্জ্যে কমেছে খাল ও জলাশয়ের গভীরতা সেগুলোকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে এসে তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হতে হবে। ক্রমশ কংক্রিট আচ্ছাদিত নগরীতে পরিণত হওয়া থেকে ঢাকাকে রক্ষায় নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে বাধাহীন করার বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে দেশের প্রতিটি নগরীর ড্রেনেজ সিস্টেমগুলো যেন সচল থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেসব জলাশয় এখনও অবশিষ্ট আছে, তাদের টিকিয়ে রাখতেও আন্তরিক হতে হবে। বনভূমি উজাড় হওয়া রোধ করার পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে ভবন ও সড়ক নির্মাণ বন্ধ করাও জরুরি।