প্রযুক্তির বাজারে নারী
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪ ১৪:১৭ পিএম
আব্দুল বায়েস
অধুনা কাজকর্মের পৃথিবী ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথাগত যে কাজ আগে মানুষ করত, তা এখন ক্রমাগত প্রযুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, গাদা গাদা তৈরি হয়ে চলেছে প্রযুক্তি-প্রবণ পেশা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং। সোজা কথায় যার অর্থ অনলাইনে নিজের দক্ষতা বিক্রি। সমর্থিত এক সূত্র থেকে পাওয়া সুখবর হলো, ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটা অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক অনলাইন শ্রম সরবরাহে ভারতের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান; ৬৫ হাজার নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার নিয়ে বৈশ্বিক বাজারের প্রায় ১৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। তা ছাড়া এ মঞ্চ এবং সুখ্যাতি বাংলাদেশের অনলাইন কর্মীদের জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য কারিগরি কর্মের ক্ষেত্র যেমন ফ্রিল্যান্সিংয়ে সব নিবন্ধিত অনলাইন কর্মীর মধ্যে নারীর অংশ মাত্র ৯ শতাংশ।
দুই
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর কয়েকজন গবেষক (রায়েদ আরমান, অনিন্দিতা ভট্টাচার্য, নারায়ন দাস, দিপান্বিতা ঘোষ, মহিমা গমেজ, লপিতা হক, কামরুজ্জামান ও সাকিব আহমেদ) ফ্রিল্যাসিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় ১ হাজার নারীর আয়, কর্মসংস্থান, আস্থা, আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা এবং জীবনধারণের ওপর এ কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়ন করেন। প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রভাবের পরিমাণ ও গুণগত দিক বিবেচনায় নিয়ে তারা একটা মিশ্রণ-পদ্ধতি অনুসরণ করেন। পরিমাণগত ফলাফল পর্যালোচনা করতে র্যান্ডমাইজড্ কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
তিন
বিআইজিডি পরিচালিত
সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত পরিমাণগত পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে দুটি শর্তই
প্রায় শতভাগ পূরণ হয়েছে। অর্থাৎ প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের শতভাগ এসএসসি ডিগ্রিধারী এবং
তাদের ৯৫ ভাগের বয়স ১৮-৩৫ বছর। ফলোআপ সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রভাব মূল্যায়নে দেখা যায়,
শ্রমবাজারে এ ধরনের প্রশিক্ষণের প্রভাব বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। যেমন প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থান,
কাজের ঘণ্টা এবং আয় বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ২৬, ৪২ ও ৫৪ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়Ñপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
নারী কর্ম ও উৎপাদনশীলতায় অগ্রগামী। এর ফলে এদের আয়ও বেশি ছিল। বলাবাহুল্য, যেহেতু
প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর, তাই আপাতত ইতিবাচক ফলের পেছনের কারণ প্রশিক্ষণ
বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে এও দেখা যায়, যারা বেশি বেশি ক্লাস করেছেন, তাদের উন্নতিও বেশি
হয়েছে। যেমন যারা ৪৮টি ক্লাসের মধ্যে কমপক্ষে ২৫টিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের ফ্রিল্যান্সিং
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ৪২ শতাংশ অথচ ১১-২৪ ক্লাসে যোগ দিয়ে বৃদ্ধি ঘটেছে ২১ শতাংশ। ১৬
শতাংশ বৃদ্ধি যারা আরও কম ক্লাস করেছেন তাদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই এ তিন ধরনের অংশগ্রহণকারীর
ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয় প্রতি মাসে যথাক্রমে ২৫০০, ২০৮৩ ও ৬৪৩ টাকা। এর বিপরীতে নিয়ন্ত্রিত
গোষ্ঠীর বেলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটেছে ১২ শতাংশ মাত্র এবং মাসিক আয় ৭৭৮ টাকা।
স্মরণ করা দরকার, ইন্টারভেনশনটি (এখন থেকে হস্তক্ষেপ) ছিল ফ্রিল্যান্সিং কর্মকাণ্ডে কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রয়োগ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সুতরাং প্রথমেই ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায় যন্ত্রটির নড়াচড়া আর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এ বর্ধিত দক্ষতা আয়কে প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন যারা প্রশিক্ষণ নেননি তাদের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি আয় ছিল যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের। স্বভাবতই বর্ধিত আয় উত্তরদাতার ভোগও বাড়ায়। যেমন এদের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বৃদ্ধি যথাক্রমে ৪৮ ও ৪১ শতাংশ। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী কেননা হস্তক্ষেপটির জন্য ভোগ বৃদ্ধি মানবপুঁজি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত খানার অনুপাত হ্রাস ও সঞ্চয়কারী খানার অনুপাত বৃদ্ধি পায়। যদিও আস্থা ও আকাঙ্ক্ষাজনিত প্রভাব তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয় বলে লক্ষ করা যায়। তার পরও সমীক্ষায় নারীর ক্ষমতায়নের কিছু নির্দেশকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। অংশগ্রহণকারীদের মনোবৈজ্ঞানিক মঙ্গল বেড়েছে। সুখ ও চাপের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠীর চার-পঞ্চমাংশ জানিয়েছে, গেল এক মাসে তারা কোনোভাবে চাপের মধ্যে ছিল না। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ বেশি ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠী অবহিত করেছে যে তারা গেল মাসে কোনো আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়নি। এবং প্রত্যাশিতভাবে এ হস্তক্ষেপের ফলে ফ্রিল্যান্সিং-সংক্রান্ত জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটেছে ১২ শতাংশ। মূল্যায়নে দেখা যায়, অংশগ্রহণের হার বা আপটেক খুব একটা বেশি ছিল না; মাত্র ৫৫ ভাগ অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে মোট ক্লাসের অর্ধেক করেছেন যেখানে অংশগ্রহণকারীর মাত্র এক-পঞ্চমাংশ সব ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন। উপদেশমূলক অধিবেশনে অংশগ্রহণের হার ছিল খুবই কম। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সংক্রান্ত অধিবেশনে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সাপেক্ষে প্রকল্পটির প্রভাবের প্রসার সম্ভবত আরও বেশি হতে পারত।
চার
গুণগত পর্যালোচনা
করতে গিয়ে গবেষকরা মূলত প্রকল্প প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে
প্রতিটি ধাপের আলোকে হস্তক্ষেপের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তুলনামূলক
আলোচনা তুলে ধরে তারা সফল ও ব্যর্থ অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণে
ব্রতী হন। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করা কিংবা ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে না যাওয়ার পেছনে
প্রধান একটা কারণ হচ্ছে সফলতার জন্য যে সময় বিনিয়োগ করা দরকার সে সময়ের অভাব। বেশিরভাগ
প্রশিক্ষণার্থীকে তাদের স্ব স্ব খানার ব্যবস্থাপনায় সময় দিতে হয়, সবার দেখভাল ও খানার
অন্যান্য কাজ সেরে প্রশিক্ষণ ক্লাসে যাওয়ার সময় থাকে না অথবা সময় থাকে খুব কম। আবার
ক্লাসে এলেও খানার বিভিন্ন বিষয়, দায়িত্ব এবং ঘটনা মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। দ্বিতীয় কারণ
ক্রেতার সঙ্গে অব্যাহতভাবে ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে পারঙ্গমতার খামতি।
কিছু প্রার্থীর ধারণা, তাদের লব্ধ ইংরেজি জ্ঞান ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় পর্যাপ্ত
নয়, যা প্রতিনিধিত্ব বা দরকষাকষির জন্য উপযুক্ত নয়। তৃতীয়ত, কিছুসংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীকে
পিতা-মাতার নৈতিক সমর্থন না পেয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।
এরা মনে করেন পিতা-মাতার সহযোগিতা পেলে প্রশিক্ষণ থেকে আরও ভালোভাবে লাভবান হতে পারতেন।
এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে পরিবারের প্রতি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে পাওয়া
উপার্জন দেখাতে হয়েছে। চতুর্থত, দরকারি সফটওয়্যার মসৃণভাবে চালাতে হলে চাই উঁচু ক্ষমতা
এবং মানসম্মত কম্পিউটার; যা অনেক প্রার্থীর লভ্যতার বাইরে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
অবশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল সফলকামীদের। তাদের না ছিল সময়ের অভাব, না ছিল পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। খুব সুন্দর করে দক্ষতার সঙ্গে দুই দিক সামলাতে পেরেছেন এ কামিয়াব নারীরা। আসলে বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্সিং করতে সময় পাওয়াটা যেমন সুবিধাজনক, পারিবারিক সমর্থন তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে তাদের ধারণা। ফ্রিল্যান্সিং যারা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সুপারিশ এবং জাতীয় ফ্রিল্যান্সিং বাজারে চাকরির খোঁজ পাওয়ার নিমিত্ত বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সংযোগ। তৃতীয়ত, কারও কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা দরকষাকষি করে নিজের নৈপুণ্য বিক্রির বেলায় অন্যের চেয়ে বেশি ছিল। সবশেষে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে কাজ করে যাওয়া এবং উন্নতি করার বেলায় বিজ্ঞ পরামর্শদাতা কিংবা সমকক্ষের সহযোগিতা সফলতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করেছেন কেউ কেউ।
পাঁচ
উপসংহারে উপলব্ধি
এই যে, ফ্রিল্যান্সিং কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ শিক্ষিত, স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত
নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নে বড় মাপের প্রভাব রাখতে পারে।কার্যকর সম্প্রসারণের স্বার্থে
বাস্তবায়নকারী, অংশগ্রহণকারী, নীতিনির্ধারকÑএ তিন শ্রেণির জন্য কয়েকটি সুপারিশ তুলে
ধরা যায়। ক. বাস্তবায়নকারীর জন্য সুপারিশ : প্রত্যেক প্রার্থীর আবেদন তার অন্তর্নিহিত
সামর্থ্য ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়নের নিমিত্ত লক্ষ্য প্রক্রিয়া শানানো। প্রশিক্ষণার্থীদের
দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য পাঠ্যসূচি প্রবর্তন এবং প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত
দক্ষতা যথাযথ কাজে লাগানোর জন্য অতিরিক্ত দক্ষতা ও জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া। অনলাইন বাজারে
বিদ্যমান ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীকে
যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা এবং অতিথিপরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সবশেষে দক্ষ বাজার কৌশল
গ্রহণ করা।
খ. অংশগ্রহণকারীদের
জন্য সুপারিশ : যোগদান করার আগে প্রশিক্ষণ
ইনস্টিটিউট এবং কাজের সুযোগ সম্পর্কে সব জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। ফ্রিল্যান্স
মঞ্চে কার্যক্রমে কার্যকর অংশ নিন এবং ভালো আচরণ প্রদর্শন করুন। বেশি পাওয়ার জন্য দরকষাকষির দক্ষতা উন্নীত করুন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের
জন্য বিদ্যমান বহুবিধ সুযোগসুবিধার সদ্ব্যবহারকল্পে করণীয় নিয়ে ভাবুন।
গ. নীতিনির্ধারকদের জন্য সুপারিশ : শ্রমবাজারে যারা পিছিয়ে রয়েছে তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং চাহিদা সৃষ্টিতে সাহায্য করুন। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং যাতে প্রয়োজনীয় সামাজিক বৈধতা পায় তার জন্য কাজ করুন। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণযোগ্য নীতিমালা ও লাইসেন্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো শক্তিশালী করুন। অনলাইন ফ্রল্যান্সিংয়ে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় কলকবজার ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করুন। ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আরও গবেষণা সহায়তা প্রদান করুন। দক্ষতার সঙ্গে কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে প্রমাণসাপেক্ষ মডেল তৈরি করুন। একটা স্থিতিশীল চাহিদা-সরবরাহ ইকোসিস্টেম সৃষ্টির জন্য বিশ্বাসযোগ্য অর্থায়ন মডেল তৈরি করুন। প্রাপ্তি আদায়ে যেন জটিলতা না হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক বিনিময় মসৃণ করুন।