× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নগরায়ণ

স্বপ্নের তিলোত্তমার লক্ষ্য পূরণ করতে হলে

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪ ১৫:২৩ পিএম

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ঢাকা মহানগরীকে অদূর ভবিষ্যতে তিলোত্তমা হিসেবে গড়ার স্বপ্ন আমাদের সবার। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও প্রত্যাশা করে ঢাকা সুযোগ-সুবিধায় নানা দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা এর উল্টো। ঢাকার সার্বিক অবকাঠামোয় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হচ্ছে। আমরা দেখছি, যত্রতত্র গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। সড়ক এখনও যাত্রীদের বড় দুর্ভোগের নাম। সড়কের সঙ্গে গণপরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাজ করা সম্ভব হয়নি। রাজধানীতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু পরিকল্পনা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু এসব পরিকল্পনা বিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক পরিকল্পনার সঙ্গে অন্য পরিকল্পনার সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অবকাঠামো সমন্বয় ও সুপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও ব্যাপক ঘাটতি লক্ষণীয়। সম্প্রতি ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজধানীর সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত। নদী-জলাশয় ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এভাবে আমাদের স্থল অবকাঠামো বাড়লেও প্রকৃতির সঙ্গে নগর পরিকল্পনার সমন্বয়ের বিচ্যুতি ঘটেই চলেছে। ঢাকায় এককালে সবুজের সমারোহ ছিল। সড়কের ধূসরে তা ছিল প্রশান্তির ছায়া। কিন্তু সে সবুজ আজ বিপন্ন। প্রখর রোদে পিচঢালা পথ এখন ক্লান্তিকর। আর সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় প্রায় গোটা মহানগর। ১২ জুলাই ফের এরই সাক্ষ্য মিলেছে। নাগরিক দুর্ভোগ এসব কারণে প্রকট রূপ নেয় যা মেনে নেওয়া যায় না।

যেকোনো শহরে বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে কয়েকটি উপাদান জরুরি। আবাসন অবকাঠামো, সবুজের অনুপাত, খেলার মাঠ কিংবা পার্কের উপস্থিতি, পথচারীবান্ধব ফুটপাথ, গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, সড়ক অবকাঠামোর উন্নতিসহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা খাতের সঙ্গে সমন্বয় করে নগরের পরিকল্পনা করা হলে প্রতিটি জায়গায় সমান মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়। ইটপাথরের অবকাঠামোতে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নয়নই এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। এত বড় কর্মযজ্ঞ সমাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থাকে স্বচ্ছতা-সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। আর স্বচ্ছতা-সদিচ্ছাকে অনুপ্রেরণা জোগায় সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় পরিবর্তন না এনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের নিরিখে সংস্কার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনার একটি বড় ঘাটতি সময়ে-অসময়ে পরিবর্তন আনা হয়। সংস্কারের ক্ষেত্রে সচরাচর পরিকল্পনার ত্রুটি ও বাস্তবায়নের সাফল্যের হিসাব থাকে। অর্থাৎ কোনো পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন হবে এমন কোনো অংশ যদি প্রকল্পের জন্য সঠিক না হয়, তাহলে তা পুনর্মার্জন করা যায়। কিন্তু পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হলে অনেক সময় বাস্তবায়িত অংশ সংস্কার করা হয়। তখন অর্থের অপচয় হয় এবং প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়।

গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ বহু পুরোনো। সম্প্রতি মেট্রোরেল চালু হওয়ায় আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা যে উন্নত হয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিগত এক দশকের নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনার দিকে তাকালে মনে হয়, সরকার মেট্রোরেলের বাইরে কোনো বড় সড়ক অবকাঠামোর কথা চিন্তা করতে পারেনি। মেট্রোরেল একটি নির্দিষ্ট রুটের যাত্রীদের জন্য স্বস্তির অবশ্যই। কিন্তু মেট্রোরেল সমগ্র ঢাকার যাত্রীদের জন্য সার্বিক স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। অতীতে এই স্তম্ভেই লিখেছি, ঢাকার অধিকাংশ যাত্রীই স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করে থাকে। এই স্বল্প দূরত্ব অতিক্রমের জন্য তারা বাসের ওপর নির্ভর করে থাকে। মেট্রোরেলে সচরাচর স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা খুব বেশি আগ্রহী থাকে না। যাদের সময় বাঁচানোর দরকার এবং দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া প্রয়োজন, তারা মেট্রোর সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু অন্যান্য রুটে গণপরিবহন আগের মতোই রয়ে গেছে। অথচ সরকারের কাছে সুযোগ ছিল, গণপরিবহন ব্যবস্থাকে আরও চৌকস করে তোলার। মেট্রোর সঙ্গে বাস সার্ভিস বা প্যারা ট্রানজিটের সংযোগ করা গেলে আরও বেশি মানুষ উপকৃত হতো। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা-উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

শুধু গণপরিবহনই নয়, আমরা দেখছি পথচারীবান্ধব ফুটপাথ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গায় বাসস্টপেজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় ভালো ফুটপাথও রয়েছে। কিন্তু ফুটপাথ ধারাবাহিকভাবে ভালো নয়। কিছু দূর যাওয়ার পরই দেখা যায় ফুটপাথ বেদখল হয়ে আছে। আবার অনেক স্থানে ফুটপাথের ওপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে অস্থায়ী বাজার করা হয়েছে। ফলে পথচারীদের একটি অংশ সড়কে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সড়কে যানজট যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। বাসযোগ্যতার নিরিখে বিশ্বের যেসব শহর এগিয়ে রয়েছে সেসব দেশ গণপরিবহন ও ফুটপাথে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কংক্রিটে ছাওয়া শহরে ফুটপাথে মানুষ নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে। স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে ফুটপাথ যদি উন্নত হয়, তাহলে অনেকে হেঁটেই চলাচল করতে পারে। কিন্তু স্বল্প দূরত্বে ঢাকার ফুটপাথের অবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে বাস বা রিকশায় যাতায়াত করে।

এ কথা সর্বজনবিদিত, একটি দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা জরুরি। শহর অবকাঠামোতেও সবুজের অনপাত ২৫ শতাংশ রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে উন্মুক্ত ময়দান কিংবা পার্ক রাখা জরুরি। পার্কের ভেতরেও অবকাঠামো থাকে। তবে তা সুপরিকল্পিত। রাজধানীর অভিজাত কিছু আবাসিক এলাকায় পার্ক দেখা গেলেও গোটা শহরে পার্ক অনেক কমে গেছে। বেশ কিছু পার্ক এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকির অভাব থাকায় অশুভ মহলের অপতৎপরতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এ নিয়ে অনেকে অভিযোগ করলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা দেখছি, অধিকাংশ বিদ্যালয়ের নিজস্ব মাঠ নেই। অনেক বিদ্যালয়ে মাঠ থাকলেও সেখানে শিক্ষার্থীরা খেলতে পারে না। মাঠের ক্ষতি হবে অজুহাত দিয়ে অধিকাংশ সময়ই বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এককালে এসব মাঠে বিকালের দিকে শিশুদের খেলতে দেওয়া হতো। আবার অনেক খেলার মাঠ বেদখল হয়ে আছে। কোনো ক্লাব বা রাজনৈতিক পক্ষ সারা বছর খেলার মাঠ বন্ধ রাখে। মাঠে শুধু জনসমাবেশ বা কোনো মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অথচ পার্ক, খেলার মাঠ ইত্যাদি নাগরিকদের স্বস্তির জায়গা। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্পের সময় মানুষ পার্কে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। এক্ষেত্রে শহর এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থানে রয়েছে। ঢাকায় গড়ে উঠছে বহুতল ভবন।

নতুন ভবনগুলোর অধিকাংশ বিল্ডিং কোড অনুসরণ করছে সত্য, কিন্তু পুরোনো অনেক ভবন বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়নি, এমন অভিযোগ রয়েছে। ফলে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে এসব ভবন ধসে পড়ার শঙ্কা অনেক বেশি। খোলা জায়গা না থাকায় মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ জলাশয়ও নেই। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা কংক্রিটে ছাওয়া। অনেক জায়গায় জলাশয় ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। কিছু কিছু জলাশয়ে ময়লা-আবর্জনা ফেলে তা দূষিত করা হচ্ছে। ফলে মানবসৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি পাওয়া যায় না। আগেই বলেছি যে, মহানগরে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। সড়কও তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা শুধু ভোগান্তি সৃষ্টি করে এমন নয়, জলাবদ্ধতার ফলে অবকাঠামোরও ক্ষতি হয়। বৃষ্টির পানি জলাশয়ে গিয়ে জমা হতে পারে না। আবার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতে ব্যবহারের কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এসবই পরিকল্পনার ঘাটতি বলেই বিবেচিত।

সম্প্রতি শহরে বিভিন্ন জায়গায় নান্দনিকতার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে সবুজ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে না। সবুজ সামান্য থাকলেও তা শুধু শোভাবর্ধনের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময় শহরে উষ্ণতা বাড়ছে। শোভাবর্ধনকারী নানা প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রেই গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে শহরে তাপমাত্রা কমানোর জন্য উপযোগী পরিকল্পনা এখনও নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি অবকাঠামোর নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও প্রাকৃতিকভাবে তাপনিরোধী বৈশিষ্ট্যের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে না। এসব কিছুই পরিকল্পনার সমন্বয়ের অভাবের কারণেই ঘটছে। রাজধানীতে বাড়ছে মানুষের চাপ। দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে বাণিজ্যÑ সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। এজন্য মানুষের চাপও বেশি। কিন্তু সবকিছুই যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মানুষের স্বস্তি কিংবা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগের ঘাটতিই বেশি লক্ষণীয়। বিদ্যমান সংকট সমাধানের জন্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনাবিদদের আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। নাহলে স্বপ্নের তিলোত্তমা ঢাকার লক্ষ্য পূরণ হবে না।

  • নির্বাহী পরিচালক, আইপিডি। নগর পরিকল্পনাবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা