সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ১০:২০ এএম
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায়
আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মেরুকরণের প্রেক্ষাপটে সমীকরণের নতুন
নতুন কৌশল কূটনীতির অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন আমাদের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী
দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্কে যে নতুন বাতাবরণ
সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলেই আমরা মনে
করি। বাংলাদেশ ও চীনের বেসরকারি বাণিজ্য খাতে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বেশ কিছু
চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ও ঘোষণাপত্র সই এবং দলিল হস্তান্তর হয়। বেইজিংয়ে ‘সামিট
অন ট্রেড, বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ ও বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড চীন’
সম্মেলনে এসব সমঝোতা ঘোষণা হয়েছে বলে ১০ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে। ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সফর সংক্ষিপ্ত করে শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আরও বলা হয়েছে, ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি
না থাকায় ১০ জুলাইয়ের মধ্যে সব বৈঠক সম্পন্ন করে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত
নেন।
সংবাদমাধ্যমে
আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও ব্যাংক খাতে সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি,
অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু
নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির
বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়েছে। বহুমাত্রিক এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্কের
পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বিষয়টি আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে আরও বড় ভূমিকা রাখবে
বলে আশা করা যায়। চীনের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে পারস্পরিক স্বার্থে বাংলাদেশের প্রধান
খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, চীন-বাংলাদেশ
হাত মেলালে বিশাল কিছু অর্জন সম্ভব।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর আলোকে বাংলাদেশ-চীন ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক
গ্লোবাল সাউথের উন্নয়নেও তাৎপর্যময় বলে আমরা মনে করি। বিশ্লেষকদের অভিমত, শেখ হাসিনার
পঞ্চম দফায় চীন সফরের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক কৌশলী ভারসাম্যমূলক সম্পর্কের বিষয়টিকে প্রাধান্য
দেওয়া অত্যন্ত সময়োপযোগী। বাংলাদেশ ও চীন হৃদয় থেকে হৃদয়ে সম্পর্কের সেতু নির্মাণ করে
ভবিষ্যতের যে পথ পরিক্রমা রচনা করেছে তা নিশ্চয় আশাব্যঞ্জক। আমরা জানি, বাংলাদেশ ও
চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদানের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। বাংলাদেশ ও চীন অবিচল
পারস্পরিক আস্থা নিয়ে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু এবং এই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই যৌথ উন্নয়নের
ঘনিষ্ঠ অংশীদারও বটে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অধিকতর উন্নয়নের জন্য কৌশলগত দিক নির্দেশনাগুলোও
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ৪৯ কোটি ডলারের যে বিনিয়োগ চীন থেকে পেতে যাচ্ছে তাও
আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ড. হাসান মাহমুদ জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে। এ
ব্যাপারে চীনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাসও মিলেছে। তিনি আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার সঙ্গে সিপিপিসিসির জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানের অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে
অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগবৃদ্ধিতে
তারা গুরুত্বারোপ করেন। চীনা ব্যবসায়ীদের প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের যে উদাত্ত আহ্বান
শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, এর পক্ষেও ইতিবাচক সাড়া অত্যন্ত লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার চীন সফর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হলেও নির্ধারিত সব কর্মসূচি শেষ করেই তিনি দেশে
ফিরেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে চীনের মতো দেশের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক এর প্রেক্ষাপটে তারা আমাদের এই সমস্যা সমাধানে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে
‘এক চীন নীতি’ অনুসরণ করে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে চীন গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করছে। বিদ্যমান বিশ্ববাস্তবতায় যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ও দেশে
দেশে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়েই বিশ্বায়নের এ যুগে সবারই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা
উচিত। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে
চীন ক্রমাগত তাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে। সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, এই সম্পর্ককে কেন্দ্র
করে চীন বলছে, তারা কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারত্বকে ব্যাপকতর অংশীদারত্বের দিকে নিয়ে
যেতে চায়। তবে আমরা মনে করি, এই সম্পর্কের মাত্রা বাস্তবতার নিরিখে যত এগোবে ততই এর
ভিত্তিও মজবুত হবে। বাংলাদেশ-চীন এই দুদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে
বিশ্লেষকরা টুইন পিলার বলছেন। চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত
করা, ঋণের সুদহার হ্রাস করা, শিক্ষাবৃত্তি বৃদ্ধি করা ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের তরফে
দাবির প্রতি চীনের ইতিবাচক সাড়ার বিষয়টিও সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে।
আমরা মনে করি,
যেকোনো সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আস্থার ভিত
যেখানে যত মজবুত সম্পর্কের ভিত্তিও ততটাই শক্তিশালী। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় সৌহার্দ-সম্প্রীতি
ও মৈত্রীর ভিত মজবুতকরণে আস্থা নিঃসন্দেহে পরিপূরক শক্তি হিসেবে কাজ করে। আমাদের বিশ্বাস
চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব কিছুই অত্যন্ত সাফল্যমণ্ডিতভাবে এগিয়ে চলেছে।
আগেই বলেছি, মেরুকরণের বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন ব্যবস্থায় বহুমুখী সমীকরণ কাজ করে এবং
এ ক্ষেত্রে কৌশলী কূটনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এও বিশ্বাস করি, এ ক্ষেত্রেও
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ধারাবাহিকভাবেই সফলতার স্বাক্ষর রেখে আসছে। বাংলাদেশ-চীনের
মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগের যে মসৃণ পথরেখা সৃষ্টি হয়েছে তাতে উভয় দেশেরই এর বাইরেও
আরও বহুমাত্রিক কাজ করার অবকাশ রয়েছে। অনস্বীকার্য বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে
বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে তার বর্তমানের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
বিশ্বের অনেক
দেশেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবেও পরিচিত। চীন এবং বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের
মধ্যে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের জন্য আরও
গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভূমিকা রাখবে। কৌশলগত অংশীদারত্ব থেকে কৌশলগত বিস্তৃত সহযোগিতা
অংশীদারত্বে উন্নীত করার প্রয়াস সাফল্যের আরও দ্যুতি ছড়াবে বলেই আমরা মনে করি। বাংলাদেশ-চীন
উভয় দেশের সম্পর্ক উত্তরোত্তর মজবুত হওয়ার পাশাপাশি বহুমাত্রীকরণের আলো ছড়াকÑ এটাই
আমাদের প্রত্যাশা।