× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্র ও সমাজ

তরুণরা তারুণ্য নিয়ে কী করবে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ১০:১৮ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বিশ্বের বহু জায়গায় প্রতিবাদী তরুণরা ফিলিস্তিনের গণহত্যার বিরুদ্ধে যখন বিক্ষোভ করছেন, বাংলাদেশের তরুণরা তখন নীরব কেন? প্রধান কারণ রাষ্ট্র চায় না তরুণরা রাস্তায় নামুক। এখন যারা রাষ্ট্রশাসন করছেন একসময়ে তরুণের বিদ্রোহ-বিক্ষোভ তারা খুব চাইতেন; তারা নিজেরাও এবং তাদের পূর্বসূরিরাও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা অভ্যুত্থান ঘটলে তাতে অংশ নিয়েছেন, নেতৃত্বও দিয়েছেন। কারণ রাষ্ট্রের শাসকরা তখন ছিলেন বিদেশি। একাত্তরে দেশ যখন স্বাধীন হলো, স্বাভাবিকভাবেই দৃশ্যপট তখন বদলে গেল। তরুণদের দমন করার পরীক্ষিত পন্থা দুটিÑ একটি হলো লোভ দেখানো, অপরটি ভয় পাইয়ে দেওয়া। পূর্ববর্তী শাসকদের মতোই পরবর্তী শাসকরাও দুটো পন্থাই গ্রহণ করলেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ দমনে ভালো রকমের সাফল্য পেলেন।

পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা যেমন ছিলেন, তেমনি সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। বস্তুত সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও বস্তুগত কারণে নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল জাতীয়তাবাদীদের দখলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ও নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদীদের হাতে ছিল এবং স্বাধীনতার পরও ক্ষমতা জাতীয়তাবাদীরাই পেলেন। জাতীয়তাবাদীরা উৎফুল্ল হলেন, সমাজতন্ত্রীরা গেলেন পিছু হটে। পিছু হটার একাধিক কারণ ছিল। প্রথম কারণ তারা ইতোপূর্বেই রুশপন্থি ও চীনপন্থিতে বিভক্ত হয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পর দেখা গেল রুশপন্থিরা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ঐক্যজোট গঠনে অস্থির হয়ে পড়েছেন। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন ঘটল, তখন রুশপন্থিদের একাংশ, যারা আগেই সংশোধনবাদের পথ ধরেছিলেন, তারা হতাশ হয়ে কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেললেন। তাদের একটি অংশ তো বিলোপবাদীই হয়ে গেল।

যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে লড়বেন ভেবে কোনো মতে টিকে রইলেন, পরে তারাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে চীনপন্থিরা শুরু থেকেই ছিলেন বিভক্ত; কারও কারও মধ্যে দেখা দিয়েছিল বিভ্রান্তি। এই ফাঁকে জাতীয়তাবাদীদের একটি অংশ বের হয়ে এলো, বিরোধী দলের সাজসজ্জা গ্রহণ করে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রত্যাশা চরিতার্থকরণে ব্যর্থ হয়ে তারা স্বতন্ত্র দল খাড়া করার উদ্যোগ নিলেন এবং জোরগলায় আওয়াজ তুললেন শ্রেণি-সংগ্রামের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সামাজিক বিপ্লবপন্থি তরুণরা ওই আওয়াজটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বিপুল সংখ্যায় তারা সাড়া দিলেন; নির্যাতিত হতে থাকলেন, আটক হলেন বহুসংখ্যক, প্রাণ হারালেন অনেকে। তরুণদের পক্ষে সমাজ পরিবর্তনের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। তারপরও কিন্তু দেখা গেছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন তরুণরাই প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানে মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ কম ছিল না, কিন্তু চালিকাশক্তি ছিলেন ছাত্ররাই।

এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক, তবে বাস্তবিক ঘটনা যে, এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর যে ‘গণতান্ত্রিক’ বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রবল ‘শত্রুতা’ শুরু করলেও এক ব্যাপারে ঐকমত্য ছিলেন। সেটা হলো তরুণদের সমাজ পরিবর্তনকামী আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগকে দমন করা। এর প্রমাণ খুঁজতে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিষিদ্ধকরণের ঘটনার দিকে তাকানোটাই যথেষ্ট। এক দলকে হটিয়ে আরেক দল ক্ষমতায় বসেছে, কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন নিরুৎসাহিতই হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নির্বাচন নিষিদ্ধই রয়ে গেছে। বুর্জোয়ারা তারুণ্যকে বড়ই ভয় করে, কারণ তারুণ্যের ভেতর তারা সর্বদাই বিদ্রোহের লক্ষণ দেখতে পান। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করছে, সেই একই আচরণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য অবশ্য রয়েছে; সেটা হলো ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের দিক থেকে নিজেদের পক্ষের ছাত্র সংগঠনকে উৎসাহ দান এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনের একাধিপত্য বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন যে রাজনীতিবিমুখতা দেখা দিয়েছে, সেটা আসলে ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নয়, সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের একাধিপত্য ও বিরুদ্ধবাদীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধেই। তরুণরা তাহলে তাদের তারুণ্য নিয়ে কী করবেন? কোথায় যাবেন? বাংলাদেশে তরুণদের জন্য তারুণ্য এখন দুঃসহ এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, নিয়ম এটাই যে, তরুণরা থাকবেন সুখে, প্রবীণরা হবেন ভারাক্রান্ত।

বাংলাদেশে প্রবীণরা যে নির্ভার রয়েছেনÑ এমন দাবি কেউই করবেন না, তবে তরুণরা যে সুখে নেই, এটাও সমপরিমাণে সত্য। আর তরুণদের পক্ষে যেহেতু অত্যন্ত স্বাভাবিক হচ্ছে আশাবাদী হওয়া, চঞ্চল ও ব্যস্ত থাকা নানা সৃষ্টিশীল কাজে, প্রতিবাদী হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তাই তাদের বিষণ্নতাটা কেবল যে মর্মস্পর্শী তাই নয়, অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জকও বৈকি। ধরা যাক এই খবরটাÑ ‘উঠতি বয়সি তরুণে ভরা কিশোরগঞ্জ কারাগার; মাদকের ছোবলে ১৪০০ থেকে ১৫০০ মাদক মামলার আসামী।’ [প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১১ মে] এই যে হাজার দেড়েক তরুণ আটক অবস্থায় রয়েছে একটি জেলা কারাগারে, এটা তো ব্যতিক্রম নয়; সব জেলা কারাগারেই এ রকম তরুণ আসামিদের দেখা পাওয়া যাবে। অথচ এই তরুণদের তো এখানে থাকার কথা নয়। তারা হয় কর্মক্ষেত্রে কর্মনিযুক্ত থাকবেন, নয়তো ব্যস্ত রইবেন পড়াশোনায়, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিকই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে বাংলাদেশে।

মারাত্মক রকমের মাদকের নাম নাকি আইস। সেটা এত দিন বাইরে থেকে আসত, এখন তৈরি হচ্ছে দেশের ভেতরেও। একটি দৈনিকের সংবাদদাতা লক্ষ করেছেন যে, সব জিনিসেরই দাম যখন বাড়ছে; তখন মাদকের ক্ষেত্রে উল্টো যাত্রা, দাম কমছে। এর অর্থ তো সোজা। সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে তরুণরা এখন মাদক সেবনে, ছিনতাইয়ে, নিজেদের ভেতর কলহে-সংঘাতে, পরস্পরকে খুন করায়, এমনকি দলবদ্ধ ধর্ষণেও তৎপর রয়েছেন; একাত্তরে তারাই (অর্থাৎ তাদের পূর্বসূরিরা) যুদ্ধ করেছেন হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তারা পরিচয় দিয়েছেন অসাধারণ উদ্ভাবন শক্তির। এবং যে সাহস ও শক্তি নিয়ে লড়াই করেছেন তা হানাদারদের জন্য ছিল প্রজ্বলন্ত ত্রাস বিশেষ। হানাদাররা যেখানে মানুষ হত্যা করেছে, তরুণরা তখন হত্যা করেছেন ভয়ংকর ভয়ংকর সব পশুকে। মুক্তির সেই সংগ্রামটা আজ নেই। তরুণদের বাধ্য করা হয়েছে নিপীড়ক আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণে। তরুণরা তাদের সৃষ্টিশীলতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন।

একাত্তরে যে তরুণ দেশের ভেতরে অকুতোভয়ে লড়াই করেছেন, আজ সে দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য সাগরের পানিতে প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। প্রায় ১০০ বছর আগে ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে/ কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।’ তাঁর সেই লেখা আজ আরও অধিক নির্মমভাবে সত্য। তরুণ চান কাজ, চান জীবনের কাজ, চান জীবিকার নিশ্চয়তা, দেশের ভেতরে যা পাওয়ার সম্ভাবনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। বিদেশে গিয়ে তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেন, দেশে টাকা পাঠাবেন বলে। একাত্তরে যে দেশপ্রেম তাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ডাক দিয়েছিল, সেই ডাক তিনি আজ ভিন্নভাবে শুনছেন। এই ডাকটাও দেশপ্রেমেরই। নিজে না-খেয়ে দেশে টাকা পাঠানো দেশপ্রেমের প্রমাণ বৈকি। তবে বড় রকমের একটা তফাত আছে। একাত্তরে তরুণরা জানতেন যে সবাই মুক্ত না হলে নিজের মুক্তি ঘটবে না; আজকে কিন্তু তারা সেটা ভাবেন না। আজকের তরুণ অন্যের জন্য চিন্তা করেন না, তার সব চিন্তা নিজেকে এবং আপনজনদের ঘিরে। দেশ অর্থ আপনজন। এক ভিন্ন ‘আদর্শ’।

একাত্তরের আদর্শটা ছিল সমাজতান্ত্রিক, আজকের আদর্শ পুঁজিবাদী। উন্নতির আড়ালে পুঁজিবাদীই দেশে বেকারত্ব সৃষ্টি করছে। নিরুপায় তরুণকে ঠেলে দিচ্ছে দেশের বাইরে। তরুণরা আইনি পথে যাচ্ছেন, যাচ্ছেন বেআইনি পথেও। সংবাদপত্র সংবাদ দিচ্ছে যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৯ হাজার ৩৭০ জন মানুষ বিদেশের কারাগারে আটক অবস্থায় কান্নাকাটি করছেন। সর্বাধিকসংখ্যক বন্দি রয়েছে সৌদি আরবে। ১০ হাজার বাংলাদেশিকে নাকি ফেরত পাঠাবে যুক্তরাজ্য। এরা কেউ শখ করে সেখানে যায়নি, গিয়েছেন কাজের খোঁজে। তাদের কাছে শ্রম ভিন্ন অন্যকিছু নেই বিক্রি করার, সাহস করে তাই শ্রমের ক্রেতার সন্ধানে বেরিয়ে গেছেন এবং গিয়ে বিপদে পড়েছেন। বিলাসীরাও অবশ্য বিদেশে যান, তবে উপার্জনের জন্য নয়, যান মেহনতি মানুষের শ্রমে উপার্জিত টাকা খরচ করার জন্য। প্রবাসী দুয়েকজন বাঙালির নাম বিশ্বের সেরা ধনীদের তালিকায় দেখে আমরা যে উল্লসিত হব, তা পারি না। কারণ মনে পড়ে যায় যে, ওই টাকার উৎস বিদেশ নয়, উৎস আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। উৎস দেশবাসীর শ্রম।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা