সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৪ ০৯:৩৭ এএম
প্রযুক্তির আশীর্বাদ বর্তমান জমানায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে
বটে, কিন্তু একই সঙ্গে এর অপব্যবহার কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, এরই নজির ফের উঠে এসেছে
৯ জুলাই প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে অনলাইন
প্ল্যাটফর্মে অশ্লীল ভিডিও লাইভ দেখিয়ে চুরানব্বই কোটি সাত লাখ পয়ষট্টি হাজার টাকারও
বেশি হাতিয়ে নিয়েছে ‘ড্রিম লাইভ’ নামে একটি অ্যাপ্লিকেশন। অশ্লীলতা বন্ধে সরকার যখন
একের পর এক পর্নোসাইট বন্ধ করছিল, তখন কৌশল পাল্টিয়ে আবির্ভাব ঘটে ‘ড্রিম লাইভ’-এর।
এর মাধ্যমে তারা বিদেশে পাচার করেছে কোটি কোটি টাকা। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ২০২২
সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ড্রিম লাইভ’-এর বাংলাদেশি এজেন্ট আবু মুসা ইমরান আহমদ সানিসহ ছয়জনকে
গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। ডিএমপি, সিটিটিসির তদন্তে
উঠে আসে ড্রিম লাইভের কর্মকৌশল পাল্টিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য। প্রযুক্তির অপব্যবহার
ঘটিয়ে প্রতারণা-হয়রানির অভিযোগের অন্ত নেই। এ ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমরা
জানি, প্রযুক্তির অপব্যবহার কিংবা হয়রানির মাধ্যমে অনেক জীবনও বিপন্ন করে তোলা হয়েছে।
আমরা যখন সভ্যতার উন্নত স্তরে বাস করছি, তখনও প্রযুক্তির অপব্যবহারে সামাজিক অবক্ষয়ের
ধস সুস্থ মূল্যবোধকে কতটা অভিঘাত করেছে, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
আমরা এও জানি, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে
যুক্ত। এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারও।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে কম্পিউটারের তথ্য হ্যাকিং সম্পর্কিত ঘটনা যেমন
বেশি ঘটছে; তেমনি প্রযুক্তির ফাঁদে ফেলে অনেককেই বিপন্ন-বিপর্যস্ত করে সামাজিক ও পারিবারিক
জীবন ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। ভুয়া সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া কিংবা
প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্যধারণ করে বিভিন্ন অনলাইন
সাইটে ছড়িয়ে দেওয়া, এমন অপকাণ্ড অহরহই ঘটছে। সিটিটিসির তদন্তে আরও উঠে এসেছে, ‘ড্রিম
লাইভ’ চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করা হতো প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। এর এজেন্ট আমাদের দেশীয় এবং
তারা সফটওয়্যার কোম্পানির নামে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পর্নো ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের ব্যবসা
খুলে বসেন। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও তাদের কৌশল পাল্টে নেয়। ‘ড্রিম
লাইভ’-এর ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাদের অধীনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সার
হিসেবে কাজ করতেন প্রায় দেড় হাজার তরুণী। সহজেই প্রতীয়মান হয়, তাদের জাল কতটা বিস্তৃত
ছিল। প্রযুক্তির আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবন নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা পাত্রের জন্য নয়।
তাই এর অপব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং হচ্ছেও তাই। এর
অপব্যবহার বিশ্বের সব জায়গায়ই কমবেশি ঘটে চলেছে। এ রকম অনেক অপরাধমূলক কাজ আমাদের সমাজের
নানাস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এর ফলে নাগরিক সমাজে আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক অবক্ষয়ের হারও
বাড়ছে। এর প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে সামাজিক
সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই, এরও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
দেশের সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অনেকেই ইতোমধ্যে তাদের অভিমত ব্যক্ত
করতে গিয়ে বলেছেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার জাতিকে শুধু মেধাশূন্যই করে দিতে পারে না,
একই সঙ্গে মানসিক বিপর্যয়েরও বড় কারণ হতে পারে। আমরা দুঃখজনকভাবে এরই আলামত লক্ষ করছি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা কিংবা বিকাশের সুফলকে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাই এবং সুস্থ অনুশীলনের
মাধ্যমে এক্ষেত্রে আরও পরিশীলিত হওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করি। কিন্তু কিছুসংখ্যক ফন্দিবাজের
কারণে এর বিরূপ অভিঘাতে সমাজ ক্ষতবিক্ষত হবে এবং এর দায়ের ছায়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে
ছড়িয়ে পড়বে, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে দেশে আইন রয়েছে
বটে এবং ইতোমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারির পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো
অনেক কুচক্রীকে আইনের আওতায় আনলেও অভিশাপের ছায়া কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যম
ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সচেতন জনগোষ্ঠীর তরফে এই প্রশ্ন বারবার উঠেছে, প্রযুক্তির
এমন অপব্যবহার রুখবে কে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, সমস্যার একেবারে উৎসে নজর দেওয়া
জরুরি। কল্পজগতের হাতছানি কত ভয়ংকর হতে পারে এবং জীবনকে কত পচা দুর্গন্ধময় ডোবায় ডুবিয়ে
দিতে পারে, এর নজিরও আমাদের সামনে কম নেই। এজন্য পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক
পর্যায়ে বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে নজরদারি-তদারকি বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। দুঃখজনক হলেও
সত্য, আমাদের পারিবারিক শিক্ষায় শাসনের বাঁধন অনেক ঢিলে হয়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপট ফিরিয়ে
আনা অত্যন্ত জরুরি।
‘ড্রিম লাইভ’ কৌশল পাল্টিয়ে প্রতারণা-অশ্লীলতার প্রতি আকর্ষণের ফাঁদ
পেতে যেভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, এর উৎস সন্ধান করে কঠোর প্রতিকারমূলক দৃষ্টান্তযোগ্য
প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে। প্রযুক্তির আশীর্বাদকে স্বাগত
জানিয়ে অভিশাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যূথবদ্ধভাবে। আমরা দেখছি, টিকটক-লাইকি সমাজে
এক ধরনের অসুস্থতা ছড়াচ্ছে এবং এ ধরনের প্রযুক্তির মাদকে যখন সমাজে অবক্ষয়ের ছায়া ক্রমেই
গাঢ় হচ্ছে; তখন এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সাঁড়াশি অভিযান চালানো জরুরি বলেও আমরা মনে
করি। এ ব্যাপারে যেমন সামাজিক অঙ্গীকার অত্যন্ত জরুরি, তেমনি এ ধরনের যেকোনো ঘটনার
রহস্য উন্মোচনে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থারও বিকল্প নেই। অবক্ষয়ের স্রোত যে বা যাদের কারণে
বেগবান হচ্ছে, তাদের মূলোৎপাটনে কালক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও
অত্যন্ত জরুরি বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক বিধায়করা যদি স্থিতিশীল-সুস্থ সমাজ গঠনে
ঐকমত্যে আসতে পারেন, যদি পারিবারিক বন্ধনের ভীত আরও শক্ত করা সম্ভব হয় এবং অভিভাবকরা
সন্তানের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সজাগ থাকেন, একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী যদি এসব ব্যাপারে শ্যেনদৃষ্টি রাখে, তাহলে এই অবক্ষয়ের গ্রাস থেকে
সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আমরা যেমন অনেক লাভবান হয়েছি, তেমনি কতিপয় কুচক্রীর
মাধ্যমে প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরূপ ফলে এই সমাজ ভুক্তভোগীও কম নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীগুলো সাইবার অপরাধ দমনে সদা সতর্ক থাকার পরও কী করে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঘটে
চলেছে, এরও উৎস সন্ধান করতে হবে। আমরা মনে করি, এর অপব্যবহার রোধ করতে হলে যূথবদ্ধ
প্রয়াস যেমন জরুরি; তেমনি সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের পরিসর ব্যাপৃত করারও
বিকল্প নেই। অশ্লীল ভিডিও লাইভ করে কিংবা ছড়িয়ে সমাজে অবক্ষয়ের গাঢ় ছায়া বিস্তৃত করার
পাশাপাশি যারা নিজেদের আখের গোছাতে মত্ত, তাদের প্রতি কোনো রকম অনুকম্পা দেখানোর অবকাশ
নেই।