যুক্তরাজ্য
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৪ ০৯:৩১ এএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের
নির্বাচন হয়ে গেল ৪ জুলাই। সম্পূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেছে এক দিন পর। ৬৫০ আসনের পার্লামেন্টে
১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা লেবার পার্টি পেয়েছে ৪১২টি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ
পার্টি পেয়েছে ১২১টি। ফলাফলের বিচারে এটাকে কনজারভেটিভ পার্টির শোচনীয় পরাজয় এবং লেবার
পার্টির ভূমিধস বিজয় বলা যায়। কনজারভেটিভরা এবার হারিয়েছে ২৫০টি আসন এবং সুনাক মন্ত্রিসভার
১১ জন সদস্য পরাজিত হয়েছেন। ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ।
লেবার পার্টির
নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার দেশটি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে নির্বাচনে ভরাডুবির
পর ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির
নেতৃত্ব থেকেও সরে দাঁড়িয়েছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এবারের নির্বাচনের দিকে গোটা
বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। বিশেষত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৪
জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার মধ্যে রুশনারা আলি, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা
হক ও আপসানা বেগম জয়ী হয়েছেন।
রুশনারা আলি এবার
নিয়ে পাঁচবার কমন্সসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন। অন্যদিকে টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক এবার
নিয়ে চারবার, আর আপসানা বেগমের এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পদার্পণ। ব্রিটেনের
পার্লামেন্টে বাংলাদেশি মেয়েদের এ বিজয় সঙ্গত কারণেই আমাদের উদ্বেলিত করে। কদাচিৎ সাফল্যের
দেখা পাওয়া আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বাংলাদেশি কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কারও
সাফল্যে উচ্ছ্বসিত। তেমনই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এবারের নির্বাচনে চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত
নারীর বিজয় আমাদের যারপরনাই আনন্দিত করেছে। শোনা যাচ্ছে, কিয়ার স্টারমারের মন্ত্রিসভায়
রুশনারা আলি অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। ব্রিটেনকে বলা হয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার। আর সে
দেশের পার্লামেন্ট সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বলা হয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পুরুষকে
নারী আর নারীকে পুরুষ বানানো ছাড়া সবই করার ক্ষমতা রাখে। এর দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনায়
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেই মূলত বোঝানো হয়েছে। সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার
পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সব পক্ষ বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে।
কোনো পক্ষ থেকেই
নির্বাচন পরিচালনা কিংবা ফলাফল নিয়ে কোনো আপত্তি তোলা হয়নি, করা হয়নি অভিযোগ। ১৪ বছর
ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি ফলাফল এতটাই নীরবে মেনে নিয়েছে যে, তা আক্ষরিক অর্থেই
জনগণের রায় মাথা পেতে নেওয়ার উদাহরণ। শুধু তাই নয়, এটা বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক
কিংবা গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার দেশগুলোর রাজনৈতিক দলের জন্য অনুকরণীয় বললেও ভুল হবে
না। ব্রিটেনের নির্বাচন নিয়ে আজতক তেমন উল্লেখযোগ্য বিতর্কের সূচনা হয়নি। বিশ্বের আরেক
উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর রিপাবলিকান দলের প্রার্থী
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য-মন্তব্য এবং তার সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলে তাণ্ডব দেশটির
গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কপালে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সে হিসেবে
ব্রিটিশরা এখন পর্যন্ত তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বলা যায়।
কয়েক দিন আগে
লন্ডনে অবস্থানরত পুত্র ইশতিয়াক সুলতান মেননকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, নির্বাচনী
পরিবেশ কেমন। মিছিল-মিটিং হচ্ছে কি না, দুই দলের কর্মী-সমর্থকরা মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে
কি না। সে বলেছিল, আমাদের দেশের মতো নির্বাচনের কোনো ‘গরম’ই নাই। সবাই যার যার কাজে
ব্যস্ত। ভোটের দিন কাজের ফাঁকে ভোটটা হয়তো দিয়ে আসবে। নির্বাচনের দিন বর্তমানে লন্ডনে
স্থায়ী বসবাসরত বাংলাদেশি সাংবাদিক রুমানা রুমি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কাজ
শেষে বাসায় ফেরার পথে ভোট দিলাম। মনে হলো যেন ভোটারশূন্য একটা ভোটকেন্দ্র।’ ফোন করেছিলাম
রুমানা রুমিকে। তিনি জানালেন, ব্রিটেনে নির্বাচনের দিন কোনো ছুটি থাকে না। যে-যার সুবিধামতো
কাছের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসে।
কী বিস্ময়কর ব্যাপার!
না নির্বাচনের আগে, না নির্বাচনের পরেÑকোনো হইচই নেই, মিছিল নেই, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে
আক্রমণ করে শালীন-অশালীন ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি নেই। কালো টাকার ছড়াছড়ি নেই, পেশিশক্তির
দাপট নেই। নিস্তরঙ্গ জলাশয়ের মতো শান্ত পরিবেশে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী দেশের জাতীয়
নির্বাচন হয়ে গেল! নির্বাচনের পরে সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল কারচুপির অভিযোগ নেই। ঋষি সুনাক
বললেন না, এ সরকারকে (টারমারের) ‘এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দেব না’। কিংবা নির্বাচনী
ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বলেননি, ‘ফলাফল মানি না বা নতুন নির্বাচন চাই’। এমনকি এটাও
বলেননি যে, তার দলের এমপিরা শপথ নেবেন না। তারা এ অভিযোগও করেননি, সারা দিন কেন্দ্র
ভোটারশূন্য ছিল (রুমানা রুমি সাক্ষী), এত ভোট এলো কোথা থেকে?
এটাই ব্রিটেনের
বৈশিষ্ট্য। এটা তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তারা আমাদের মতো মৌখিক গণতান্ত্রিক নয়, আক্ষরিক
অর্থেই গণতান্ত্রিক। আমরা মুখে বলি, ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’। কিন্তু অন্তরে ধারণ করি
না, মানি তো না-ই। বিটেনের জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি
শ্রদ্ধাশীল বিধায় তাদের ওখানে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় না। তদুপরি সেখানকার
নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা এবং জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও বিশ্বাস প্রশ্নাতীত।
বিশেষত সেখানকার রাজনৈতিক দল ও সেগুলোর নেতৃত্ব ক্ষমতালিপ্সু নয়। সেজন্য যেভাবেই হোক
‘ক্ষমতায় থাকতে হবে’ কিংবা ‘ক্ষমতায় যেতে হবে’ এ মানসিকতা তাদের গ্রাস করেনি। রাজনীতি,
রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ব্রিটিশদের কাছে দেশ ও জনগণকে সেবা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রিত্ব
কিংবা মন্ত্রিত্ব তাদের কাছে ‘দায়িত্ব’মাত্র, ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করে বিত্তবৈভব
গড়ার ম্যান্ডেট নয়। আমার কথায় আমাদের দেশের কোনো রজনীতিক রুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা
অস্বীকার করব কীভাবে?
ভাবতে অবাক লাগে, এই ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করেছে ১৯০ বছর। তাদের তাড়াতে এ উপমহাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সাতাত্তর বছর আগে এ উপমহাদেশের দখলদারি ছেড়ে ব্রিটিশরা চলে গেছে। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, গণতন্ত্রের আচরণের শিক্ষা গ্রহণ করিনি। যদি গ্রহণ করতাম, তাহলে অনেক রাজনৈতিক ঝামেলা থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারতাম। নির্বাচন কিংবা ফল নিয়ে এত বিতর্ক হতো না।