সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:৫৬ এএম
ভৌত, রাসায়নিক
ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হালদা নদীর অস্তিত্ব সংকট কতটা প্রকট হয়ে উঠেছে সে চিত্র উঠে
এসেছে ৩০ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানার বর্জ্য, বিষ
দিয়ে শাখা খালের মাছ নিধন, ড্রেজারের আঘাত ইত্যাদি বহুবিধ নেতিবাচক কারণে দেশীয় মাছের
প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হালদা রক্ষায় সরকার ইতোমধ্যে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও
নদীটির বৈশিষ্ট্য ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু দখল কিংবা দূষণই নয়, হালদায় কুদৃষ্টি
পড়েছে বালুখেকোদেরও। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ হালদার স্বাভাবিকতা বিনষ্টকারী অনেক কিছুই
চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। আমরা জানিÑ দেশীয় রুই, কাতল, মৃগেলসহ কার্ফ জাতীয় মাছের
প্রজননক্ষেত্র হালদার অস্তিত্ব রক্ষার দাবি নতুন নয়
শুধু নদীর বৈশিষ্ট্য
রক্ষার স্বার্থেই নয়, সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও হালদাকে রক্ষা করতেই হবে। হালদার
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎপন্ন খালগুলোর অবস্থা যেমন শোচনীয়, তেমনি এর উপনদীগুলোও পড়েছে
হুমকির মুখে। দেশে বিপুলসংখ্যক নদ-নদী রয়েছে। অনেকগুলোর তুলনায় হালদা ছোট নদী হলেও
এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ভিন্নমাত্রিক। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সপ্তাহজুড়ে ফিচার পাতাগুলোর
নামকরণ করা হয়েছে নদ-নদীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার নিরিখে। দেশের অন্যান্য
নদ-নদীর চেয়ে হালদার আলাদা বৈশিষ্ট্য এর ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে। আমরা জানি, এই
নদীটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে উল্লিখিত মাছগুলোর নিষিক্ত ডিম
সংগ্রহ করা হয়। আমাদের জানা মতে, আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদ-নদী থেকে এ জাতীয় মাছের ডিম
সংগ্রহ করা যায় না। দেশে মৎস্য প্রজননক্ষেত্র আছে অনেক বটে, কিন্তু মাছের নিষিক্ত ডিম
সংগ্রহ করা হয়Ñ এমন নদী একটিই এবং সেটি হালদা। হালদায় মাছের প্রজনন সময় হচ্ছে এপ্রিল
থেকে জুন মাস পর্যন্ত। এই তিন মাসে ছয়টি ‘জো’ আছে। অর্থাৎ অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথিতে
যা ‘জো’ হিসেবে চিহ্নিত, তখন মাছগুলো ডিম ছাড়ে। হালদাকে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক জিন
ব্যাংক বলা যায়।
কিন্তু প্রাকৃতিক
জিমপুল হালদার অস্তিত্বের গুরুত্ব কতটা ব্যাপক এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
হালদাকে চট্টগ্রামের ‘লাইফলাইন’ও বলা হয়। বহুমাত্রিক গুরুত্ব সত্ত্বেও হালদার ওপর কিছুসংখ্যক
লোভাতুর ও অপরিণামদর্শী যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, তা বহুমাত্রিক ক্ষতির কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের একদিকে বঙ্গোপসাগর, একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে ব্যতিক্রম
বৈশিষ্ট্যের নদী আজকের বিপন্ন হালদা। চট্টগ্রামের একমাত্র ‘ফ্রেস ওয়াটার সোর্স’ হালদার
অস্তিত্ব সংকট দেখা দেওয়ায় এ অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হওয়ার শঙ্কাও বাস্তবতা।
হালদা থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে উৎপাদিত রেণু,
রেণু থেকে ধানি, ধানি থেকে আঙ্গুলি এবং আঙ্গুলি থেকে খাবারের জন্য মাছ সংগ্রহ করা হয়।।
প্রাণিবিদ্যা ও মৎস্য গবেষকদের অভিমত, হালদার অস্তিত্ব ক্রমাগত বিপন্নতার কবলে পড়ায়
ঝুঁকি বাড়ছে পরিবেশেরও। তাদের মতে, এই নদীর একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বেশ কিছু
‘কুম’ আছে। ‘কুম’ হচ্ছে কোনো স্রোতস্বিনী নদীর স্রোতের মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর স্থান যেখানে
মা মাছগুলো প্রজননের পর বসবাস করে এবং ডিম ছাড়ে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই বৈশিষ্ট্যগুলো
ক্রমাগত যারা ধ্বংস করছেন তারা সমাজের জন্য হিতকর নন। হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য
অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলোর কেন সমাধান করা যাচ্ছে না,
আমরা এ প্রশ্ন রাখি।
ইতোপূর্বে সংবাদমাধ্যমেই
উঠে এসেছে, হালদার সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নদীভাঙন রোধের
জন্য গৃহীত প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় নদীতে ব্লক ফেলার জন্য প্রচুর জিওব্যাগ ফেলা
হয়েছে। এর ফলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদায় আরেক দফা অভিঘাত লেগেছে। ব্লকের
কারণে মা মাছের আবাসস্থল ‘কুম’গুলো ভরাট হয়ে গেছে। গবেষকদের মতে, দশটি কুমের মধ্যে
সাতটিই ভরাট করে ফেলা হয়েছে। বাকিগুলোরও অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। শিল্পকারখানার
বিষাক্ত বর্জ্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে পোল্ট্রি, গৃহস্থালি এবং মানববর্জ্যও। দেশের মিঠাপানির
মা মাছের পোনা উৎপাদনের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদার বিপন্ন দশার দায় সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। ইতোপূর্বে দূষণে ডলফিনসহ প্রাণীবৈচিত্র্যের অস্তিত্বের
মূলে যে অভিঘাত লাগে এর প্রেক্ষাপটে হালদা রক্ষায় নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল।
হালদার অস্তিত্ব সংকটের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছে দফায় দফায়।
হালদা রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, দূষণ
ও দখলকারী যে বা যারাই হোন না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে যথাযথ আইনানুগ
পদক্ষেপ নিতেই হবে। হালদা এবং সেখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য যে প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছে
এর নিরসন জরুরি। এ পর্যন্ত হালদার যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। প্রায় ৫ হাজার কেজি
মাছের রেণু উৎপাদনের মতো অবস্থায় হয়তো এই নদীটিকে আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু ক্ষতির
পরিমাণ আর যাতে স্ফীত না হয়, এই লক্ষ্যে অবিলম্বে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো
বিকল্প নেই।
হালদার মা মাছ,
বিপন্নপ্রায় প্রজাতির ডলফিন ও প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত
হোক। হালদা রক্ষায় কোনো রকম অবহেলা-উদাসীনতা মেনে নেওয়া যায় না। হালদাকে বিপর্যয় থেকে
রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সংশ্লিষ্ট
সব পক্ষের যূথবদ্ধ প্রয়াস। হালদার গুরুত্ব বিবেচনায় যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে
ঘাটতি রয়েছে বলে আমরা মনে করি। হালদা রক্ষায় নতুন করে বলার আর কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে
স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সমিতি, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদীরা
কর্মসভা-মানববন্ধন-সভা-সেমিনার ও স্মারকলিপিসহ নানা প্রচারণায় শিল্পবর্জ্য নিঃসরণ বন্ধসহ
দখল-দূষণ নিয়ে অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে না বিধায়ই হালদা
নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং এর অস্তিত্ব সংকটে বহুমাত্রিক বিরূপতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
আমরা আশা করি, বিলম্বে হলেও হালদা রক্ষায় কাজের কাজ হবে।