× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আইএমএফের শর্ত

ভারসাম্যপূর্ণ রিজার্ভ ও বৈদেশিক ঋণ, দুই-ই চ্যালেঞ্জ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:৫০ এএম

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি মার্কিন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২৭ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এ অর্থ যোগ হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬৫০ কোটি বা ২৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশ ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করে। ওই আবেদনের ছয় মাস পর গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ৩৮টি শর্তে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি। তখন আইএমএফ জানায়, শর্তপূরণ সাপেক্ষে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে ঋণের এ অর্থ দেওয়া হবে। এরই মধ্যে তিনটি কিস্তি পাওয়া গেছে। আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ায় আমাদের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু)-এর দেনা বাবদ প্রায় ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। তখন আবার রিজার্ভ কমে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভারসাম্যপূর্ণ রাখা এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের আর্থিক খাতের জন্য আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি আসা বড় স্বস্তি নয় বেশ কিছু কারণে। কারণ আমাদের রিজার্ভ খানিকটা বাড়লেও তাতে অর্থনীতির বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব হবে না। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে সম্প্রতি জানিয়েছে, মেগা প্রকল্পের আসল পরিশোধের জেরে গত ১১ মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রেকর্ড ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশ তার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর মোট ঋণ পরিশোধ করেছে ৩ দশমিক ০৬৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে সুদ ও আসল মিলিয়ে বাংলাদেশ পরিশোধ করেছিল ২ দশমিক ৪৬৭ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর থেকেই বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধের চাপ বেড়েছে। আগামী অর্থবছরগুলোয় পরিশোধের পরিমাণ ক্রমান্বয়েই বাড়বে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক ঋণের জন্য উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

লার সংকটের এ সময় বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার দেওয়া স্বল্পমেয়াদের ঋণের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। ইতোমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তিও শুরু হয়েছে। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে অন্যান্য মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে। আইএমএফ বরাবরই তাদের বিভিন্ন মেয়াদি ঋণের বিপরীতে কিছু শর্ত দেয়। কিছু কিছু বিষয়ে তারা পরামর্শও দেয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে তাদের কিছু কিছু পরামর্শ অবশ্যই ভালো। তবে আমাদের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয়তার নিরিখে কিছু কিছু জায়গায় ভর্তুকি কমানোর বিষয়টি সঠিক নয়Ñএ কথা ইতঃপূর্বে এ স্তম্ভেই বহুবার লিখেছি।

আমরা জানি, উচ্চমাত্রার দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতি বছর সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরামর্শ দিয়েছেদুর্নীতি কমাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ দেওয়া সরকারের জন্য মোটেই সুখকর বিষয় নয়। সরকার নিজে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। প্রতি বছর দেশের বাজেটের বিরাট একটি অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক খাতে। অথচ প্রশাসনের বিভিন্ন স্থানে সমন্বয়হীনতার অভাব, দুর্নীতির অভিযোগ বরাবরই প্রশ্ন উত্থাপন করে। প্রশাসন যদি তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সুচারূভাবে সম্পন্ন করতে না-ই পারে তাহলে কেনই বা তাদের পেছনে এত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছেÑসঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন দেখা দেয়।

আমরা দেখছি, প্রশাসনের অনেকেরই আয়বহির্ভূত সম্পদের কোনো হিসাব নেওয়া হয় না। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ উঠে আসে কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়গুলো সচরাচর এড়িয়ে যাওয়া হয়। দেশে বর্তমানে যে ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন, তাদের সামান্য অংশই সম্পদের হিসাব দিয়ে থাকেন। দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতিবৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হবে এমনটিই স্বাভাবিক। আর্থিক খাত ও ব্যাংকব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে ব্যবসা সহজীকরণের যে প্রচেষ্টা হচ্ছে, তার অগ্রগতি খুব সামান্য। বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক সমাধান বের করা জরুরি।

বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বিদেশে চাকরিবাকরি করছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী কতিপয় বাংলাদেশি ছাড়া অন্য সবাই নিয়মিত দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। কিন্তু অনেকেই বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠায় না। হুন্ডি ব্যবসার কারণে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পৌঁছে না। আবার দেশের রপ্তানি আয়েরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে রেখে দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত বিরতিতে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া সত্ত্বেও সংকট কাটছে না। বৈদেশিক মুদ্রার দুষ্প্রাপ্যতার আর একটি কারণ হচ্ছে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা, এক্সচেঞ্জ হাউস এমনকি সাধারণ মানুষও দাম বাড়িয়ে ডলার/পাউন্ড/ইউরো পরে বিক্রি করার জন্য বেশ কিছু দিন নিজেদের আয়ত্তে রেখে দিচ্ছে। ডলার-পাউন্ডের অবৈধ ব্যবসার কারণেও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের পাশাপাশি দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগও ক্রমান্বয়ে কমছে।

টাকার মূল্যের পতন, পুঁজি বাজারের প্রাইস সিলিং, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ডলার সংকট, এনবিআরের ট্যাক্সছাড়ের সুবিধা প্রাপ্তি, মুনাফা প্রত্যাবাসনে জটিলতা ইত্যাদি কারণে বিগত কয়েক বছর বৈদেশিক বিনিয়োগ কমার প্রবণতা দেখা গেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ছে। কারণ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ না এলে দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ ব্যাহত হয়। আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। নতুন বাজার সম্প্রসারণ এবং নিজস্ব পণ্য রপ্তানির দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। শুধু কয়েকটি বড় খাতের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। আয় বাড়াতে হবে। বর্তমান বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। নতুন বাজার সন্ধান এবং নতুন ব্যবসা খাত গড়ে তুলতে হবে। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাতের ওপর ঋণনির্ভরতার কথা বলা হয়েছে। এমনটি হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বাণিজ্য উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়বেন। তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য আর্থিক খাতে ঋণ প্রয়োজন। অন্যদিকে আর্থিক খাতে দুর্ব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে সাধারণ মানুষ এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এমনটি সম্ভব হবে না।

আমরা দেখি, বৈদেশিক ঋণ এলে রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ বরাবরই সমালোচনা করে। তাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে দায় চাপানোর ভাগটাই বেশি। তবে কিছু কিছু কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। যেমন বৈদেশিক ঋণের চাপ তো আমাদের বাড়ছে, এমনটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া আইএমএফের সব শর্ত বা পরামর্শ আমরা পালন করতে পারব না। এ মুহূর্তে আমরা তাদের শর্ত পূরণ করতে পারছি বিধায় তারা আমাদের ঋণ দিচ্ছে। আরও চার কিস্তি পেতে এখনও কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে তা বিবেচনায় সামনের পথ বেশ কঠিন। তাই তৃতীয় কিস্তি পাওয়ায় রিজার্ভ বাড়ায় আমাদের বড় পরিবর্তন আসছে অর্থনীতিতে, এমনটি ভাবলে চলবে না। বরং আর্থিক খাতে বিদ্যমান সংকটগুলো নিরসনে কাজ করতে হবে। আইএমএফের সব শর্ত একসঙ্গে পালন না করলেও প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তাতে লাভ আমাদেরই। দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কথা হয়েছে যত কাজ হয়নি তত, তা যেন দায়িত্বশীলরা ভুলে না যান।

  • অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা