দুর্নীতি
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:৪৫ এএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
স্কুল জীবনে পরীক্ষায়
গরু বিষয়ক রচনা লিখেছেন অনেকেই। তবে ছাগল নিয়ে কোনো রচনা বা নিবন্ধ পড়তে বা লিখতে হয়নি।
শিক্ষার কারিকুলামপ্রণেতারা কেন ছাগল বিষয়ক রচনা পাঠ্য বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করেননি, তা
নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে তারা হয়তো এ গৃহপালিত নিরীহ চতুষ্পদ প্রাণীটির গুরুত্ব
অনুধাবনে সক্ষম হননি। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই ছাগল আছে। তবে অঞ্চলভেদে এর আকার-আকৃতিতে
তারতম্য দেখা যায়। কোথাও ছাগল হয় কিছুটা খর্বাকৃতির, আবার কোথাও বেশ উঁচু ও দীর্ঘকায়।
সাদা, কালো, সাদা-কালো মেশানো, বাদামি ইত্যাদি রঙের ছাগল দেখা যায়। ছেলেবেলায় দেখেছি
প্রায় আধহাত লম্বা কানওয়ালা এক ধরনের ছাগল। এগুলোকে বলা হতো ‘পাটনাইয়া ছাগল’। আমাদের
দেশে কুষ্টিয়ার ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’ প্রজাতির ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু বলে জনশ্রুতি
রয়েছে। প্রচলিত আছে, ছাগীর দুধ হাঁপানি রোগীদের জন্য উপকারী। এজন্য মহাত্মা গান্ধী
নিয়মিত ছাগীর দুধ পান করতেন। আর সেজন্য সব সময় সঙ্গে একটি ছাগল রাখতেন। ১৯৪৬ সালের
দাঙ্গা প্রশমনের জন্য তিনি যখন নোয়াখালী এসেছিলেন, কতিপয় দুষ্টলোক ওই ছাগলটি চুরি করে
খেয়ে ফেলেছিল।
সেই অতিশয় নিরীহ
প্রাণী ছাগল এবার আমাদের দেশে বছরের ‘আলোচিত চরিত্র’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তৃণভোজী
এ প্রাণীটিও যে তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারে তা কারওই ধারণায় ছিল না। দেশব্যাপী এ ছাগলকাহিনীর
জন্মদাতা একজন বড় সরকারি কর্মকর্তার কিশোর পুত্র। সদ্য উদ্যাপিত ঈদুল আজহা উপলক্ষে
কোরবানি দেওয়ার জন্য ১২ লাখ টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনে সে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে।
কিশোরের নাম মুশফিকুর রহমান ইফাত, সে এনবিআরের ‘কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল’-এর
প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের ছেলে। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিতে ইফাতকে ওই ছাগলটির
গলা জড়িয়ে ধরে রাখতে দেখা গেছে।
একটি ছাগলের দাম
১২ লাখ টাকায় উঠতে পারে, এটা ছিল সবার কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে এখন আর তা অবিশ্বাস্য
নয়। যদিও ছাগল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের বরাত দিয়ে পত্রিকার খবরে
বলা হয়েছে, ১ লাখ টাকা দিয়ে বায়না করলেও শেষ পর্যন্ত ছাগলটি ডেলিভারি নেয়নি ইফাত। হয়তো
বাবার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এ উচ্চমূল্যের ছাগল কেনার বিষয়টি আইনি জটিলতা সৃষ্টি
করতে পারে, সেজন্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এ চেষ্টা। তবে ঈদে ইফাত ৭০ লাখ টাকায় কয়েকটি
গরুও কিনেছেন এসবই বিদ্যমান বাস্তবতার উৎকট চিত্র।
মুসলমান জিলহজের
১০ তারিখ আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা ইত্যাদি কোরবানি
করে। সামর্থ্যবানেরা চেষ্ট করেন যথাসম্ভব হৃষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি দিতে। অবশ্য ইদানীং
আমাদের সমাজে কোরবানি দেওয়া কতিপয় ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে বিত্তবৈভবের শানশওকত প্রচারের
প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। এসব বিত্তবান কোন পথে বিত্তবৈভব অর্জন করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন
রয়েছে। কোরবানির পশুর দাম নিয়ে সব সময়ই সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয়। মনে আছে, সম্ভবত ১৯৭৬
সালে ঢাকার নয়াবাজার কোরবানির হাটে একটি ষাঁড়ের দাম হাঁকা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা। হইচই
পড়ে গিয়েছিল তখন। এখন একটি মোটামুটি দেখার মতো গরুর দাম কমপক্ষে দেড়-দুই লাখ টাকা।
আর ১৫ হাজার টাকার নিচে কোরবানি দেওয়ার মতো ছাগল পাওয়া যায় না বললেই চলে। সেখানে একটি
ছাগল যখন ১২ লাখ টাকায় বিক্রির খবর শোনা যায়, তখন সাধারণ মানুষের চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার
পাশাপাশি এ প্রশ্নও এসে যায়Ñওই কিশোর এত টাকা
পেল কোথায়?
এর জবাব রয়েছে
২১ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে উদ্ধৃত রয়েছে ইফাতের
এ ছাগল কেনার অর্থের উৎস কোথায়। বলা যায়, ছেলের ছাগলপ্রীতির কারণে বাবা মতিউরের দুর্নীতির
থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের পথে-বিপথে অর্জিত সম্পদের
যে বিবরণ রয়েছে, তা যেন রূপকথার গল্পের মতো। খবরে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন ও
সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মতিউরের সম্পদ অর্জনের তথ্যানুসন্ধান শুরু করেছে।
ছাগল নিয়ে ভাইরাল
হওয়ার পর মতিউর ইফাতকে নিজের ছেলে বলেই অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ
বিভিন্ন পত্রিকায় বাবা মতিউর ও ছেলে ইফাতের একই রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত যুগল ছবি প্রকাশের
পর তা আর অস্বীকার করার জো রইল না। সেই সঙ্গে তিনি যে স্ত্রীসম্পদেও সম্পদশালী তা-ও
জানা গেল। খবরে বলা হয়েছে, মতিউরের দুই স্ত্রী এবং পতিভাগ্যে তারাও একেকজন অঢেল সম্পদের
মালকিন! একজন আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেত্রী ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান।
চাকরিজীবনে মতিউর
দুর্নীতি করে কী পরিমাণ অর্থসম্পদ অর্জন করেছেন, এই বিবরণ দেখে বিস্ময়ে হাঁ হতে হয়।
মাত্র একটি ব্যাংকেই রয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গুলশান, সাভারসহ
বিভিন্ন এলাকায় জমি ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। নরসিংদীর বেলাবোয় রয়েছে ৪০ বিঘা জমির ওপর
বিলাসবহুল রিসোর্ট। মতিউর এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদের পূর্ণ বিবরণ এ ছোট নিবন্ধে
উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বিস্ময়কর প্রশ্ন হলো, একজন সরকারি কর্মকর্তা লোকচক্ষুর অন্তরালে
কীভাবে এমন ‘সমুদ্র চুরি’ করতে সক্ষম হলেন? প্রতি বছর নাকি সরকারি কর্মকর্তাদের আয়কর
রিটার্নের সঙ্গে অর্জিত সম্পদের বিবরণ জমা দিতে হয়। মতিউর যে তার আয়কর রিটার্নে সম্পদের
তথ্য গোপন করেছেন তা না বললেও চলে। এটা গুরুতর অপরাধ সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্র ও সরকারের
বিভিন্ন পর্যায়ে উপবিষ্ট কর্তব্যক্তিদের এ লাগামছাড়া দুর্নীতির কারণ কী, তা ভেবে কেউই
কূল পাচ্ছেন না। তাহলে কি রাষ্ট্রের শাসনরজ্জু ঢিলে হয়ে পড়েছে? যে কারণে দুর্নীতিবাজদের
রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না? সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অহরহ তাবৎ সমস্যার জন্য বিরোধী
দলকে দায়ী করেন। সরকারি কর্মকর্তাদের লুণ্ঠন ও চৌর্যবৃত্তির দায়ও কি তারা বিরোধী দলের
ওপর চাপাবেন? ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা
নেই। দেশের মানুষও তা-ই চায়।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা সরকারের অধীন। তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও সরকারের। এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি নাÑসে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বললে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাখোশ হন। বলেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এসব বিরোধী দলের অপপ্রচার। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে যদি উল্টো তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়, বেনজীর-মতিউরদের দৌরাত্ম্য কখনোই কমবে না।