সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১৩:৪২ পিএম
দেশের কয়েকটি
বিভাগের মানুষ বন্যার শঙ্কা নিয়ে এবার ঈদুল আজহা উৎসব পালন করে। ১৯ জুন প্রতিদিনের
বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র
উঠে এসেছে। বৃহত্তর সিলেটে ইতোমধ্যে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ার খবরও উঠে এসেছে।
গত মাসের শেষের দিকে সিলেটে বন্যায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল এর উপশম হতে না হতেই ওই অঞ্চল
ফের বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় মানুষের কপালে দুর্ভোগের ভাঁজ মোটা হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের
উখিয়ায় ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে হতাহতের মর্মস্পর্শী খবর আমাদের ব্যথিত না করে পারে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে জানা যায়-সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে আরও ভারী
বৃষ্টিপাত হতে পারে এবং পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে। উজান থেকে নেমে আসা
পাহাড়ি ঢল আর কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে কুড়িগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায়
বন্যার বড় ধকলের আশঙ্কা রয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের কয়েকটি জেলার আন্তঃসড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও
ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার খবর সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে।
দেশের উল্লেখযোগ্য
অংশজুড়ে বন্যার যে পূর্বাভাস মিলেছে তাতে আমরা দুর্গতদের সহায়তায় বহুমুখী কর্মসূচি
জোরদার করার তাগিদ দিই। রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতি
আরও অবনতি ঘটার আগেই ওই সব এলাকার মানুষদের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ
তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি জানমালের সুরক্ষায় যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ ব্যবস্থা নিতে
হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রকৃতির বৈরী আচরণ মোকাবিলায়
অভ্যস্ত হলেও ক্ষয়্ক্ষতি এড়ানোর মতো পরিস্থিতি অনেকাংশেই কঠিন। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে,
দুর্যোগকবলিত এলাকায় সরকারের যথেষ্ট সহায়তামূলক কর্মতৎপরতা সত্ত্বেও দায়িত্বশীল কিছুসংখ্যক
অসাধুর অপতৎপরতার কারণে বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষ অধিকতর নাকাল হয়। আমরা আশা করব, সরকারের
ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।
আমাদের অভিজ্ঞতায়
এও আছে, দেশের অনেক এলাকাতেই এ মৌসুমে বন্যাকালীন পরিস্থিতিতে মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে
পড়ে বন্যানিয়ন্ত্রণের সুরক্ষা বাঁধগুলো ভেঙে যাওয়ার কারণে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্রও কম উঠে আসেনি।
মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণির বলবান নিজেদের আখের গোছাতে বরবারই তৎপর। পানির
তোড়ে প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম জলাধারগুলোর পাশাপাশি নদ-নদী অনেকটা ভরাট হয়ে যাওয়ার
কারণে এগুলোর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় দ্রুত জনপদ প্লাবিত হয়ে পড়ে। ভাটির দেশ
হিসেবে উজানের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কয়েকটি রাজ্যের পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কারণে বরাবরই
ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছি। বন্যার বহুমুখী বিরূপ প্রভাব মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি
ক্ষয় করে দেয়। গত দুই দিনে পরিস্থিতির যতটা অবনতি ঘটেছে এর বিপরীতে প্রতিরক্ষামূলক
ব্যবস্থা কতটা কী নেওয়া হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের
মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বন্যার পূর্বাভাস ছিল, কিন্তু তা এতটা বিপদ হিসেবে দেখা দিতে
পারেÑ সেটি সম্ভবত ধারণার মধ্যে ছিল না। বন্যা প্রাকৃতিক বাস্তবতা এবং ভাটির দেশ হিসেবে
পানি বাংলাদেশ দিয়েই নামবে, এটি খুব স্বাভাবিক ভূমণ্ডলগত হিসাব। এ অবস্থায় জানমাল রক্ষার
সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই।
বন্যার পূর্বাভাস
আরও বলছে, পরিস্থিতি অধিক গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে উজানে আবহাওয়ার বৈরী
আচরণগত কারণে। বন্যাকবলিতরা মূলত খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েন। আমাদের অভিজ্ঞতায়
আরও আছে, বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও সাহায্য-সহযোগিতা সময়মতো না পৌঁছানোর
ফলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ে। আমরা আশা করব, বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে বিশুদ্ধ পানি
ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা প্রয়োজনের নিরিখে নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন ওষুধ
ও খাবার স্যালাইনও। বন্যা পরিস্থিতিতে নানা রকম রোগব্যাধির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যগত
বহুবিধ সংকটই দেখা দেয়। আমরা আহ্বান জানাই, সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বন্যাকবলিত
এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক যাতে মেডিকেল টিম সক্রিয় থাকে তা নিশ্চিত করা জরুরি। বন্যাকবলিত
অঞ্চলগুলোতে দরিদ্র ও সক্ষম মানুষ নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিস্থিতি বেশ
জটিল। সক্ষমরা নানা সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন,
কিন্তু পানিবন্দি হিসেবে তারাও খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকটে পড়েন। আমরা মনে করি, ত্রাণ
তৎপরতার ক্ষেত্রে এ দিকগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
দেশের অবকাঠামোগত
উন্নয়ন ইতোমধ্যে কম হয়নি। জেলা সদর তো বটেই, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত যেহেতু
কম বেশি এর ছোঁয়া লেগেছে সেহেতু অঞ্চলভিত্তিক প্রয়োজনের নিরিখে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে
নানা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার পথও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন
পর্যন্ত দেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানিই বাড়তির দিকে। বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে এবং অনেক
অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছেও। সেই প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হওয়ার আগেই সরকার ও স্থানীয়
প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এও আশা
করব, সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থা বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সামনের বিপদের আশঙ্কা
আমলে রেখে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি থাকবে। যদি সেরকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়,
তাহলে মানুষ ও গবাদি পশুর জীবন রক্ষার পাশাপাশি দুর্ভোগ কমানো এবং ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম
পর্যায়ে রাখা যাবে। এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের যেহেতু এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট
অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেহেতু প্রয়োজন হলো দায়িত্বশীল সবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে
দায়িত্ব পালন করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের
কারণে আবহাওয়াজনিত পরিস্থিতি প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং এর অন্যতম শিকার আমরা।
এখন সর্বাগ্রে জরুরি বন্যাকবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুর্ভোগ লাঘবে সব রকম
ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যও প্রস্তুতি রাখতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ বন্যার প্রকোপ কমাতে নদ-নদীসহ সব জলাধারের পানি ধারণক্ষমতা
অর্থাৎ গভীরতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকসহ
সামাজিক সংগঠনগুলোর সংগঠকদেরও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। যূথবদ্ধ প্রচেষ্টায়
পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারলে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করা অনেকটাই সহজ হবে।