বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত
মোহাম্মাদ আলী শিকদার
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১৩:৪১ পিএম
মোহাম্মাদ আলী শিকদার
বাংলাদেশের একমাত্র
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) নানা গুজব ছড়ানোর
অভিযোগ উঠেছে। এতদিন কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে দ্বীপটিতে যেতে বাংলাদেশের নৌযানগুলো
নাফ নদের মিয়ানমারের কিছু অংশ ব্যবহার করত। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের
কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে সেই রুট কিছুটা সরিয়ে আনা হয়েছে। এটিকে নিয়ে ফেসবুকে নানা
গুজব ছড়াচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তবে এসব গুজব ভিত্তিহীন বলছে প্রশাসন। টেকনাফের
শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচরে চর জেগে যাওয়ায় দেখা দেয় নাব্যতা সংকট। এই নাব্যতা সংকটের
কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে গত ১০ বছর ধরে জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোটগুলোকে যাতায়াত
করতে হয় মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমা দিয়ে। একেবারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ
এই জলসীমা অতিক্রম করতে সময় লাগে ৩০ মিনিটের বেশি। কিন্তু এতদিন নাফ নদের মিয়ানমার
অংশ দিয়ে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন রুটের সব নৌযান চলাচল করলেও কোনো সমস্যা হয়নি।
চলতি বছরে মিয়ানমারের
অভ্যন্তরে শুরু হয় সংঘাত। এর জের ধরে এই মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমায় চলছে
গোলাগুলি। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ রাখা হয় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে নৌযান
চলাচল। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুট ১০টির বেশি
জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচরে চর জেগে যাওয়ায় মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া
চ্যানেল ৩০ থেকে ৪০ মিনিট তাদের অভ্যন্তর দিয়ে জাহাজগুলোকে যেতে হয়। মিয়ানমারের
সংঘাতের আগে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোটগুলো নির্বিঘ্নে চলাচল
করেছে। আগেই বলেছি চলতি বছর থেকেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুরু হয়। ফলে নিরাপত্তার
স্বার্থে মৌসুমের আগেই নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর বিকল্পপথ ইনানী ও কক্সবাজার
শহরের নুনিয়ারছড়া ঘাট দিয়ে জাহাজ চলাচল করে। মিয়ানমারের সংঘাত এটি তাদের অভ্যন্তরীণ
বিষয়।
গত ৫ জুন থেকে
নাফ নদের মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া জলসীমায় নতুন করে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিয়ানমারের
স্থলভাগে অবস্থানরত বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে নাফ নদের জলসীমায় অবস্থানরত
মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে থেমে থেমে গুলি ও গোলাবর্ষণ করে। এর কিছু অংশ এসে পড়ছে
বাংলাদেশের জলসীমায়। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি
সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে যাতায়াত
করতে গিয়ে গুলিও এসে পড়ে ট্রলারে। তবে কেউ হতাহত হয়নি। নিরাপত্তার স্বার্থে এই নৌরুটে
বন্ধ করে দেওয়া হয় নৌযান চলাচল। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। তাদের যুদ্ধের
কারণে দুর্ভোগ কিংবা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দ্বীপবাসীকে। এরই মধ্যে বিকল্পপথ বঙ্গোপসাগর
হয়ে ট্রলার নিয়ে শুরু হয়েছে যাত্রীদের যাতায়াত ও কক্সবাজার থেকে জাহাজে খাদ্যসামগ্রী
গেছে সেন্টমার্টিনে।
দ্বীপবাসীর পাশাপাশি
দ্বীপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। তারা আমাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা
দিয়ে যাচ্ছেন। নৌযান চলাচল স্থগিত এবং খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমার নৌবাহিনীর টহল
বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপটির স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। এমতাবস্থায় প্রশাসন কর্তৃক
দ্বীপের স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা রোধে আরাকান আর্মির
সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন করা যেতে পারে। এ ছাড়াও, সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য
টেকনাফের সাবরাং ট্যুরিজম ইকো পার্কসংলগ্ন সাগর উপকূলে একটি জেটিঘাট নির্মাণ করা যেতে
পারে। টেকনাফের সাবরাং ইকো পার্ক বিচ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব আনুমানিক ২৪
কিলোমিটার। অপরদিকে বর্তমান জেটিঘাট (দমদমিয়া কেয়ারি জেটিঘাট) থেকে সেন্টমার্টিনের
দূরত্ব আনুমানিক ৩৪ কিলোমিটার। টেকনাফের সাবরাং ট্যুরিজম ইকো পার্কসংলগ্ন সাগর উপকূলে
জেটিঘাট নির্মাণ করা হলে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে টেকনাফের যোগাযোগ সহজ ও কম সময়ে সম্পন্ন
হবে। এতে স্থানীয় জেলে, পর্যটক ও সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন
রুটে যাতায়াতে কম সময় লাগবে এবং সহজ ও নিরাপদ হবে।
ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন
দখল হওয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ১৬ জুন গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার
জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। তারা জানায়,
‘মিয়ানমারের চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ সেন্টমার্টিনের নিকটবর্তী হওয়ায় ওই সংঘর্ষকে
কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্টমার্টিনের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী
মহল কর্তৃক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সকলকে এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ
করা হলো।’ আমরা জানি, সেন্টমার্টিনকে নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করে সেন্টমার্টিনকে নিজেদের
মানচিত্রে যুক্ত করে মিয়ানমার কয়েকবার তাদের মানচিত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই প্রচার-প্রচারণা সামনে এসেছিল যে, সেন্টমার্টিনে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌঘাঁটি করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার
ওই নৌঘাঁটি করতে দিতে রাজি হচ্ছে না বলে তাদের সরাতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তৎপর রয়েছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের
একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিস্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ করেছেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে
বলেও জানান তিনি। তবে কোন দেশ এই প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি উল্লেখ করেননি প্রধানমন্ত্রী।
চলতি বছরের ২৩ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের এক বৈঠকের সূচনা
বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এর জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী
তার কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে সরাসরি কোনো দেশের নাম বলেননি। সম্প্রতি গণমাধ্যমের
এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান হওয়ায় তার নিকট
নানা গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তিনি যা জানেন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। আর
যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ যদি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কোনো অংশ নিয়ে নতুন রাষ্ট্র
গঠন করতে তৎপরতায় চালায়, তবে তা কখনও তারা প্রকাশ করবে না। তারা প্রকাশ্য স্বীকার করবে
না। সাধারণত ওই ধরনের তৎপরতা অতি গোপনে চালানো হয়। ভূরাজনীতির খেলায় বাংলাদেশের নাম
জড়িয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
ভূরাজনীতির খেলায়
সেন্টমার্টিন ও তার সংলগ্ন এলাকা বিশ্বপরাশক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের
মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতায় সেন্টমার্টিন-কেন্দ্রিক জলরাশির নিয়ন্ত্রণ কার নিকট থাকবে
তা শেষপর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। সেন্টমার্টিনে নৌঘাঁটি
নির্মাণ করা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সেন্টমার্টিন এখনও জীবন্ত
প্রবাল দ্বীপ। তা ছাড়া এর ভূমি ও জলের স্তরে নৌঘাঁটি করলে দ্বীপের অস্তিত্ব হুমকির
মধ্যে পড়বে কিনাÑ এমন প্রশ্নও রয়েছে। কিন্তু নৌঘাঁটি না করেও সেন্টমার্টিন ও তার জলরাশিতে
সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। নৌঘাঁটি ছাড়াই বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড
ওই এলাকায় তাদের উপস্থিতি বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অনুমতি পেলে স্থায়ী
নৌঘাঁটি না করেও তাদের সামরিক তৎপরতা চালাতে পারবে। তাই নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি এখানে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা
সেন্টমার্টিন ও এর জলরাশিতে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় কিনাÑ
সেই বিষয়টি।
যুক্তরাষ্ট্র
সরাসরি কখনও ওই বিষয়ে না বললেও একথা সত্য যে, তাদের চলমান চীন মোকাবিলার নীতির জন্য
বঙ্গোপসাগরের জলরাশিতে তাদের নিয়মিত সামরিক উপস্থিতি দরকার। তাদের সাম্প্রতিক দক্ষিণ
এশিয়া ও বাংলাদেশ নীতিতে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক
উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা অতীতের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে তাদের
অস্ত্রশস্ত্র যুক্ত করতে এবং সামরিক সদস্যদের অধিকসংখ্যক প্রশিক্ষণ প্রদানে তারা বেশ
আগ্রহী। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে যেকোনো উপায়েই সম্পর্ক বলবৎ রাখতে চায়, তা তাদের সাম্প্রতিক
তৎপরতায় প্রমাণ করে। বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন
নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি। বাংলাদেশে নিযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রদূত ও তাদের নির্বাচন-পূর্ব
তৎপরতার জন্য যতটা মুখরক্ষা করা দরকার ততটা করেছে।
নির্বাচনোত্তর সরকারের সঙ্গে নরম সুরে তাদের কথা বলা এবং চলমান সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ঘোষণা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সম্প্রতি সাবেক একজন সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাদের ওইসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অর্থ এমন নয় যে, তারা বাংলাদেশকে ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার মতো শত্রুরাষ্ট্র বিবেচনা করে। বরং তারা বাংলাদেশকে আরও কাছে পেতে চায়। বাংলাদেশকে তারা বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে, বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছে বলেই তারা কূটনীতির অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করছে।