শ্রদ্ধাঞ্জলি
বিমল গুহ
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১৩:৩৮ পিএম
বিমল গুহ
চলে গেলেন কবি
অসীম সাহা। শাহবাগ, বইমেলা, টিএসসি, কাঁটাবন, হাতিরপুল, নীলক্ষেত বা বাংলা একাডেমিসহ
নানা জায়গায় দেখা হতো অসীম দার সঙ্গে। গল্প-আড্ডায় মুখরিত সময়ের প্রাণচঞ্চল কবি অসীম
সাহা আর নেই। অনন্ত, অসীমের পানে তার এ চলে যাওয়া, মানবজীবনের চিরন্তন সত্য। বেদনাভারাক্রান্ত
হৃদয়ে বাংলা কবিতার এ শুদ্ধতম কবিকে অনুভব করব। অসীম সাহার নামের সঙ্গে ‘শুদ্ধ’ কবি
অভিধা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অগ্রজ অসীম সাহাকে দেখেছি সেই সত্তর দশকেই, আমার লেখালেখি
শুরুর দিনগুলোয়। তখনই তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ব্যাকরণ শুদ্ধ, ছন্দবন্ধ কবিতা
রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধ। শুদ্ধতার দিকে ছিল তার ঝোঁক, এ প্রবণতার কারণেই সম্ভবত তার
নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শুদ্ধ শব্দটি। তার এ শুদ্ধতার নমুনা অভিধান প্রণয়ন। প্রচলিত
অভিধানগুলোর ভুলের বিষয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন পাঠকের হাতে থাকুক
একটি শুদ্ধ অভিধান। সেই অভিধান প্রণয়নের আগে তিনি প্রায় ১০ বছর এ কাজে ব্যয় করেছেন।
অসীম সাহা চেয়েছিলেন
তার প্রণীত অভিধান যেন পাঠককে সহায়তা করে, পাঠকের বিভ্রান্তি দূর করে। অভিধান যেন কোনোভাবেই
পাঠবিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি না করে সেদিকে তিনি সতর্ক নজর রেখেছিলেন। কবি অসীম সাহা
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কবি। দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও প্রথম বই প্রকাশের
ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সময় নেন। বেশ দেরি করেই বের হয় তার প্রথম কবিতার বই। ১৯৮২ সালে
প্রকাশ পায় তার প্রথম কবিতার বই ‘পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়’। বইটি প্রকাশের
পরই আমাদের মাঝে সাড়া ফেলেছিল।
অসীম সাহার পৈতৃকনিবাস
মাদারীপুরে। যদিও তার জন্ম মাতুতালয়ে, নেত্রকোনায় ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৫ সালে
মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৯ সালে
স্নাতক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে।
এর পর থেকে ছিলেন ঢাকারই বাসিন্দা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজধানীতেই কেটেছে। পেশা
হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। নিজে প্রেসের ব্যবসা করেছেন। সেখান থেকে পরিচিতদের
বইও প্রকাশ করেছেন। অসীম দা ছিলেন উদ্যমী মানুষ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মানুষ। তিনি
মানুষকে মনে রাখতেন, ভালোবাসতেন। একসময় নিজেই উদ্যমী হয়েছিলেন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশে।
দৈনিক ‘চিরদিন’ নামে একটি কাগজের প্রকাশনার অনুমতিও নিয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল, কিন্তু
সাধ ছিল না। ফলে কাগজটিকে নিজের মনের মতো করে পাঠকের কাছে উপস্থিত করতে পারেননি। শেষ
সময়ে কাঁটাবনের কনকর্ড টাওয়ারে দোকান নিয়েছিলেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করবেন, নবীন-প্রবীণের
বই প্রকাশ করবেন। কিন্তু অসুস্থতা তার সে ইচ্ছেকেও পূর্ণরূপ দিতে দেয়নি। নিজের শরীরের
অবস্থা হয়তো তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাই হাসপাতালে থাকতেই দোকানটি ছেড়ে দেন বলে জেনেছি।
অসীম সাহা কবিতা
লিখেছেন। একজীবনে তিনি কবিতাযাপন করেছেন। কবিতাকে ভালোবাসার পুরস্কারও পেয়েছেন। পাঠকের
ভালোবাসার সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেমন তাকে মূল্যায়িত করেছে, তেমনভাবে
তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য সরকার ২০১৯
সালে তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। অসীম সাহার
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে তার সাহিত্যমূল্য বিচারের সুযোগ নেই। তিনি সাহিত্যে নানামুখী
ভুবনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। একদিকে কবিতা লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ
লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘কালো পালকের নিচে’, ‘পুনরুদ্ধার’,
‘উদ্বাস্তু’, ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’, ‘অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব’ ইত্যাদি। তিনি অনুবাদ
করেছেন অক্টাভিও পাস ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা। যদিও তিনি বিদেশি ভাষার সাহিত্যকে বাংলার
সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াকে সরাসরি অনুবাদ বলতেন না। বলতেন বিনির্মাণ। শুধু বিদেশি সাহিত্যই
নয়, তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ভান্ডার থেকে আধুনিক পাঠকের জন্য বিনির্মাণের কাজ
করেছেন নিরলসভাবে। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। মধ্যযুগের কবি
বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’-এর ভাষার প্রাচীনত্বের কারণে আধুনিক পাঠকের
পক্ষে এর রসাস্বাদন করা কঠিন। পাঠককে মধ্যযুগের অন্যতম এ সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে পরিচয়
করিয়ে দিতে কবি অসীম সাহা এ কাব্যটিও আধুনিক বাংলা ভাষায় বিনির্মাণ বা তরজমা করেন।
যার মাধ্যমে প্রাচীন কাব্যটির সঙ্গে পাঠকের যোগসূত্র তৈরি হয়।
অসীম সাহা ছন্দের
বিষয়ে ছিলেন খুবই সচেতন। ছন্দকে তিনি তার কাব্যের অন্যতম অনুষঙ্গ করে তুলেছিলেন। বাংলা
ছন্দের সব ধরনের প্রকাশই খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পূর্ব-পৃথিবীর
অস্থির জ্যোৎস্নায়’ যেমন তেমন পরবর্তীতে প্রকাশিত প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই তিনি ছন্দকে
গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলার প্রধান তিনটি ছন্দের সব ধরনের চালের উদাহরণই নিপুণ দক্ষতায়
দেখিয়েছেন তার ‘পুনরুদ্ধার’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। অসীম সাহা লেখালেখিতে যেমন তেমন
চলনে-বলনেও ছিলেন শতভাগ কবি। কবিতার পাশাপাশি তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
গান রচনার দিকেও ছিল তার প্রবল ঝোঁক। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি একটি গানের দলও করেছিলেন।
সেখানে গানের চর্চার পাশাপাশি তরুণদের সঙ্গে আড্ডার মাধ্যমে সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন।
কবিতার পাশাপাশি তিনি বিচিত্র বিষয়ে যেমন প্রবন্ধ লিখেছেন, তেমন লিখেছেন গল্প-উপন্যাসও।
সমাজ সংস্কারের চিন্তাও ধারণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইরের পৃথিবীর পরিবর্তনের
জন্য কাজ করতে হবে শিশুদের মনোজগতে। সেই ধারণা থেকে ছোটদের জন্যও লিখেছেন। তিনি যা
কিছু করেছেন তার সবের মধ্যেই ছিল তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি। তার দক্ষ সম্পাদনায় প্রকাশ
পেয়েছিল, ‘চিরায়ত কিশোর কবিতা’; যা আমাদের সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।
১৮ জুন, ২০২৪-এ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় চিরনিদ্রায় গেলেন কবি অসীম সাহা। জন্ম-মৃত্যুর সময়ের হিসাবে প্রায় ৭৫ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি। মানবজীবনের অধ্যায়ে তা খুব কম নয়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যও যথেষ্ট নয়। আর এ সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। সৃষ্টির আনন্দে অবগাহন করেছেন। বাংলা সাহিত্যকে নানাভাবে ভরিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার অন্তিম সৎকার হবে না নিজের শরীর দান করে দেওয়ায়। নশ্বর পৃথিবী থেকে অবিনশ্বর যাত্রায় বিদায়ি শ্রদ্ধা, অসীম দা।