× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঈদ উৎসব

অসাম্প্রদায়িক মহিমায় চিরভাস্বর

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৪ ১৬:১১ পিএম

অসাম্প্রদায়িক মহিমায় চিরভাস্বর

সর্বজনবিদিত যে অবাধ মুক্ত বিশ্বাস ও যথার্থ জীবনদর্শন উন্মোচন করে হাজার বছরের সংস্কার এবং ধর্মান্ধতার বৃত্ত ভেঙে পবিত্র কুরআন মানবজগৎকে করেছে অপরিমেয় আলোকবর্তিকায় উদ্ভাসিত। জাগতিক-পরজাগতিক সব চিরায়ত সত্য প্রকাশ করে মহান প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে মানবিক গুণে ঋদ্ধ হওয়ার অমিয়-বারতা-সমৃদ্ধ কুরআন প্রতিটি ধর্মবর্ণসম্প্রদায়নির্বিশেষে সব মতপার্থক্যের অবসানে সফল ভূমিকা পালন করে আসছে। অজ্ঞতাকে মহাপাপ হিসেবে অভিহিত করে সমগ্র মানবসমাজকে জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির পথে ধাবিত হওয়ার অসাধারণ অনুপ্রেরণা এ মহাগ্রন্থ। কুরআন শব্দের ‘কুর’ অর্থ পড়া আর ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ। অতএব এর আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘সর্বক্ষণ পাঠ করো’। বিশ্বজনীন আশংসিত সত্য যে; পবিত্র ইসলাম ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে কলমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। এ অবশ্যপালনীয় রুকনসমূহের মধ্যে রোজা পালন ও হজ আদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মে প্রকৃত বিশ্বাসী নাগরিক সারা বছর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সব ইহকালীন লোভ-লালসা সম্বরণ করে নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে সৎ-পূতপবিত্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের উদ্দেশে উপহারস্বরূপ মহান স্রষ্টা আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদ্‌যাপন প্রবর্তন করেন।

পুরো একটি মাস মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রতিফলনের উপহারস্বরূপ ঈদুল ফিতর এক অপূর্ব উৎসব। এ উৎসবসমূহ ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, শোষক-শোষিত প্রত্যেকের জন্যই অনাবিল সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মানবিকতার মাহাত্ম্য অত্যুজ্জ্বল করে। শ্রেণিপেশানির্বিশেষে প্রত্যেকেই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবারদাবার এবং নামাজ শেষে প্রীতি-বিনিময়ের অনুষঙ্গে ঈদ হয়ে ওঠে সর্বজনীন। আবার এ ঈদ ঘিরেই সারাটা বছর বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত ব্যবসায়ীরা মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরনের আকর্ষণীয় কাপড়চোপড় ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি বিক্রির মহোৎসবে মেতে ওঠে। পুরো বছরের সব আয়োজন সম্পন্ন হয় রোজার মাস ও ঈদ উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে। একই ধারায় ঈদুল আজহা বা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করে সবাইকে নিয়ে আনন্দসহকারে ভোজন-বিতরণ উৎসব অত্যন্ত উপভোগ্য। অমর অক্ষয় সত্যাগ্রহ শক্তির মহিমায় মানবজাতির হৃদয়ে লালিত পশুশক্তির নিধন এবং ত্যাগের প্রেরণা উন্মোচনের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ঈদুল আজহার তাৎপর্য।

মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ আদিপিতা হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে প্রচলিত ছিল বলে নানা তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণে স্বীকৃত। কিন্তু অবিচ্ছিন্নভাবে এ কোরবানি ঈদের পবিত্র ধারা আবির্ভূত হয় মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আমলে। বর্তমান বিশ্বে সব মুসলিম সম্প্রদায় যে মিল্লাতের অধীনে অধিষ্ঠিত তারও প্রতিষ্ঠাতা ইবরাহিম (আ.)। মহান আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি থেকেই ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মুসলমানরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি দেয়। মূলত মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগের মহত্ত্বকে শাশ্বত, সম্মানিত ও মর্যাদাসীন করার লক্ষ্যেই মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) মুসলমানদের কোরবানির ঈদ পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ দিন বিশ্বের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আল্লাহর নৈকট্যলাভের আশায় ইবরাহিম (আ.) প্রবর্তিত ত্যাগ ও কোরবানির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঈদুল আজহা উদ্‌যাপন করে। কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ কুরআন মজিদে ঘোষণা করেছেন, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ কায়েম করো এবং কোরবানি করো’ (সুরা আল কাউসার-২)।

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ প্রত্যয়টি কুরআনে ‘কোরবানি’র পরিবর্তে ‘কোরবান’ হিসেবে ব্যবহৃত। পবিত্র হাদিসেও ‘কোরবানি’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর বিপরীতে ‘উজহিয়াহ’, ‘জাহিয়া’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে ‘ঈদুল আজহা’ যার আররি প্রতিশব্দ ‘কোরবান’। মূলত আরবি শব্দ ‘কোরবাতুন’ বা ‘কোরবান’ থেকে কোরবানি শব্দের উৎপত্তি। এ কোরবানির শাব্দিক অর্থ ত্যাগ। পবিত্র ইসলামের চতুর্থ রুকন হজ পালনের অংশ হিসেবে ১০ জিলহজ পশু উৎসর্গের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম ত্যাগের আদর্শ স্থাপন এবং মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভে নিজের মনের সব আকুতি নিবেদন করে। ওই কারণেই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোরবানির ঈদ পালন করেছেন এবং সামর্থ্যবান কোরবান বর্জনকারীদের সম্পর্কে সতর্কবার্তা নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ কোরবানির স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদের দান করেছেন’ (সুরা আল হজ-৩৪)।

রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘কোরবানির দিনে আল্লাহর উদ্দেশ্যে রক্ত প্রবাহিত (কোরবানি করা) অপেক্ষা প্রিয়তর কোনো কাজ নেই। অবশ্যই কিয়ামতের দিন (কোরবানিদাতার পাল্লায়) কোরবানির পশু তার শিং, পশম, খুরসহ হাজির হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা প্রফুল্ল মনে কোরবানি করো’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। নির্দিষ্ট বয়সি গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো পশু দিয়ে কোরবানি ইসলামে অনুমোদন নেই। দৈহিক ত্রুটিযুক্ত পশু যেমন কানা, খোঁড়া, কানকাটা, লেজকাটা, শিং ভাঙা ও পাগল পশু দ্বারা কোরবানি করা নিষিদ্ধ। (শামি, পঞ্চম খণ্ড) মহানবী (সা.) প্রিয় কন্যাকে কোরবানি সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে ফাতিমা! আপন কোরবানির কাছে যাও। কোরবানির প্রথম রক্তবিন্দুতে তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ হবে এবং জন্তুটি কিয়ামতের দিন সমুদয় রক্ত, মাংস ও শিং নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তোমার আমলের পাল্লা ৭০ গুণ ভারী হবে।’ (ইসবাহানি)

ঈদুল আজহা বা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করে সবাইকে নিয়ে আনন্দসহকারে ভোজন-বিতরণ উৎসব অত্যন্ত উপভোগ্য। মুসলমানদের কোরবানির মাংস খাওয়া এবং অন্যকে দেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে আদেশ দিয়ে বলেন, ‘এরপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও’ (আল কুরআন-২২:২৮)। নবীজি (সা.)ও কোরবানির মাংস খেতে উৎসাহ দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিছু খাও, কিছু সঞ্চয় করো এবং কিছু গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দাও’ (নাসাই)। কোরবানির সারবত্তা হচ্ছে : অর্থবিত্তের বিনিময়ে নিছক পশু জবাই নয়, অন্তরের প্রগাঢ় অন্ধকার ও হিংস্র পশুত্ব নির্মূল করা না গেলে উপযাচিত এসব কর্ম কখনোই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থিত হবে নাÑনিঃসন্দেহে তা বলা যায়।

মুসলিম জীবনে অসীম গুরুত্ব-তাৎপর্যময় উৎসব ঈদুল আজহা। উৎসবটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে ধর্মীয় অনুভূতি। ঈদ শুধু বিলাসিতা বা আনন্দ উপভোগের নাম নয়। এতে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ-সহমর্মিতা-ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম বৈশিষ্ট্য। সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য-বন্ধুত্বের চিত্ত-বৈজয়িক উপযোজনে সার্থক হয়ে ওঠে ঈদের এ আনন্দ উৎসব। বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান অনুষঙ্গ নানামাত্রিকতায় সমাজ বিবর্তনের সাম্প্রতিককালে এ উৎসব শুধু ধার্মিকতায় নয়, ধর্ম-দলমতনির্বিশেষে এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিকশিত। ঈদ উৎসব বা পূজা-পার্বণে ধর্মবর্ণ-জাতপাত-ধনী-গরিব নির্বিশেষে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় আসীন করার মধ্যেই প্রকৃত ধর্মের বাণী উচ্চারিত। বাঙালির ঈদ উৎসব বা সবাইকে নিয়ে আনন্দের ভাগাভাগিতে মেতে ওঠা, নাচগান, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামোয় না রেখে ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উপস্থাপিত হলেই ঈদের তাৎপর্য অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে; সেটিই স্বাভাবিক। এভাবেই মানবসমাজের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসন এবং অনুশীলন সামাজিক সম্পর্কের গঠন ও অভিজ্ঞতাকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আরোপিত হয়ে এটি সম্প্রীতির বৈশ্বিক রূপায়ণে অনুভবনীয় মহিমায় পরিপূর্ণ হবেÑএ প্রত্যাশা শুভবোধসম্পন্নদের। বিশ্বের সব মানবসন্তানের প্রতি পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা।


  • শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক। সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা