× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সিলেটে বন্যা

পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর অভিঘাতের বিরূপ ফল

ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪ ০৯:৩০ এএম

ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক

ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক

বন্যা নিয়ে ভালো গবেষণা হয় এমন একটি দেশ নেদারল্যান্ডস। বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনায় শ্রেষ্ঠ হলো নেদারল্যান্ডস। সেখানকার বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্টির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর ৪ বিলিয়ন মানুষ ভবিষ্যতে বছরে অন্তত এক মাস ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে পারে। সে হিসেবে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ রয়েছে বন্যার ঝুঁকিতে। এশিয়ার পানি নিষ্কাশনের নালা বা ড্রেন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। আজ থেকে দুই দশক আগেও বন্যার একটি চক্র ছিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ১০ বছর পর পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার সম্মুখীন হতো। সাম্প্রতিককালে বন্যার পরিধি-পরিসর বেড়েছে। এর বহুবিধ কারণের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন, যা নিয়ে ১৯৬০-এর দশক থেকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা কথা বলে আসছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করে এমন কর্মকাণ্ড বন্ধ করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এতে খুব কমসংখ্যক দেশই গুরুত্ব দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো স্থানীয় সমস্যা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর কারণ বৈশ্বিক; সমাধানও বৈশ্বিক উদ্যোগেই আসতে হবে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কিছু কিছু দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনের কর্মকাণ্ডের জন্য যতটা দায়ী, তার চেয়ে এ পরিবর্তনের অভিঘাত তাদের ওপর বেশি যারা মোটেও এ কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়। বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম ও নির্দোষ শিকারে পরিণত করেছে। তার পরও সারা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর তথা জলাশয়সমূহ হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রয়ণের প্রাকৃতিক ব্যূহ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার কথা ছিল, তা না করে আমরা তা ধ্বংস করেছি ও অবশিষ্টাংশ অবলীলায় ধ্বংস করে চলেছি। ফলে প্রতি বছর আমরা জলাবদ্ধতা ও বন্যার কবলে পড়ছি। গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশের ৫৫-৬০ শতাংশ এলাকা বন্যার কবলে পড়ে, যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। সঙ্গে আছে জনগণের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

আবহাওয়া দপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে সতর্কতা ছিল যে, মে’র তৃতীয় থেকে শেষ সপ্তাহে বন্যার কবলে পড়তে পারে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এপ্রিলে সিলেটে আগাম বন্যার পূর্বাভাস থাকলেও তা হয়নি বলে হাওর এলাকার কৃষক বোরো ধান ভালোভাবে ঘরে তুলতে পেরেছে। এপ্রিলের শেষ দিকে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্ন আচরণ তথা তীব্র তাপদাহ নাভিশ্বাস তুললেও হাওরের কৃষক অন্তত ধান কাটা ও শুকিয়ে তা ঘরে তুলতে পেরেছে। মে’র প্রথম দিক থেকে আবহাওয়াবিদরা সিলেট বিভাগ বন্যার কবলে পড়ার সতর্কতা জারি করে আসছিলেন। ২২ এপ্রিল ও ১৩ মে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশে দুটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপদাহের পর বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে সিলেট বিভাগ, কয়েকটি জেলা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সারা দেশের মতো সিলেট অঞ্চলে ২৭ মে সোমবার থেকে ৩১ মে শুক্রবার পর্যন্ত পাঁচ দিন থেমে থেমে প্রবল বর্ষণ ও বৃষ্টিপাত হয়। ১ জুন সকাল থেকে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বর্ষণ ও থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উজানের দেশ ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায়ও প্রবল বর্ষণ ও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। দেশের বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢল ও উজানের দেশ ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে সিলেটের জৈন্তা, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।

ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে প্লাবিত হয়েছে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি ও গোয়াইন নদী। সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমান্ত সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানিও বাড়ছে হুহু করে। সুরমার পানি উপচে প্রবেশ করে সিলেট নগরীর অভিজাত এলাকা খ্যাত উপশহরসহ বেশকিছু এলাকায়। নগরীর মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, আলমপুর গত শুক্রবারই বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। উপশহর, কালীঘাট, শেখঘাট, কাজির বাজারসহ বাণিজ্যিক এলাকাসমূহেও পানি প্রবেশ করছে। সিলেট সিটি করপোরেশনসহ ১৪ উপজেলার মধ্যে ১০টির ৭৬১ গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৮২ জনের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছে (ডেইলি স্টার, ৪ জুন, ২০২৪)। এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হওয়া তীব্র ও ভয়াবহ তাপদাহের পর সারা দেশের মতো সিলেটবাসী এক পশলা বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো আকাশপানে চেয়ে থাকলেও এখন এ বৃষ্টিই দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলেট বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা শুকাতে সময় লাগবে।

হাওর, বিল, নদ-নদী ও কৃষি অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের জন্য এ বৃষ্টি হচ্ছে আশীর্বাদ। সেই বৃষ্টিতে সিলেটের ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি। ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে সিলেট জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টি থামলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না যদি ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায় বৃষ্টিপাত বন্ধ না হয়। বন্যা বিশেষজ্ঞ নয়, একজন সাধারণ মানুষও বোঝে সিলেট এলাকার বন্যা বৃষ্টি ও ঢলের চেয়ে ভারতের বৃষ্টি ও ঢলের পানির সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং অনেকে ইন্টারনেটে ভারতের এসব রাজ্যে বৃষ্টি ও বন্যার খবর খোঁজে। অনেকেই বুঝে গেছে বাংলাদেশের বন্যা বা এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে কি না প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বৃষ্টিপাতের ওপর। যদি আগামী কয়েক দিন বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলে আশা করা যায় পানি দ্রুত নেমে যাবে।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে, ২০২৪)।

সিলেটে পাহাড়ি ঢল, প্রবল বর্ষণ ও ভারতের উল্লিখিত তিন রাজ্যের ঢল ও বৃষ্টিপাতের পানি নেমে আসা নতুন কোনো বিষয় নয়। উজানের পানি ভাটিতে গড়াবে এটিই স্বাভাবিক। হাজার বছর ধরে সেটা চলে আসছে। আন্তঃসীমান্ত নদী, ছড়া, খালসমূহ এ পানি বয়ে হাওরে নিয়ে যায়। আবার তাহিরপুর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তার কয়েকটি হাওরে সরাসরি ভারতের পানি নেমে আসে। এসব জলাশয় ধ্বংস করার ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। গত কয়েক দিনে ১/২ ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ ডুবে যায়। সেটা আকস্মিক বন্যা নয়; বরং এটি জলাবদ্ধতা। সংবাদপত্রে উঠে এসেছে সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকার কাজ করেছে সিটি করপোরেশন। চলছে ৫৫ কোটি টাকার কাজ। পাউবো সুরমার খননে বরাদ্দ পায় ৫৫ কোটি টাকা। এসব কর্মযজ্ঞের ফলাফল উপশহরের মতো অভিজাতসহ শতাধিক এলাকা পানিতে ডুবে যাওয়া। সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক ও মানবিক দুর্ভোগ। এভাবে সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে অর্থ ঢাললে কোনো ফল আসবে না। সিলেটের পানি নিষ্কাশনের মূল প্রাকৃতিক ব্যূহ হচ্ছে সুরমা নদী ও এর সঙ্গে সংযুক্ত ছড়া খালসমূহ ও পুকুর-দিঘিগুলো। পাউবো দুই বছরে যেখানে ৫৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে তো জনগণের দুর্ভোগ থাকবেই। সিলেটের দিঘিসমূহ আজ নামে রয়েছে, বাস্তবে নেই। ছড়াগুলো সংস্কারের নামে ড্রেনে পরিণত করা হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশগত ছাড়পত্রের ধারণাও নেই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো নির্মাণেও পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সমীক্ষা বিবেচনায় আনা হয়নি। যে বক্স কালভার্টকে জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যার কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে, সেই বক্স কালভার্ট রয়েছে নগরজুড়ে। সিলেটের পানি বিভিন্ন ছড়া ও নালার মাধ্যমে সুরমা হয়ে হাওরে পতিত হয়।

বিগত দুই দশকে হাওরে পরিবেশ-প্রতিবেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ সিলেট শহর বা জেলা নয়, পুরো বিভাগের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। হাওরে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ যে সঠিক হয়নি তা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। পরিবেশবাদীরা যখন এ নিয়ে কথা বলেছেন, তখন তাদের উন্নয়নের শত্রু আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের বন্যার পর পরই আমি একটি সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে অষ্টগ্রাম যাই। সেমিনার শেষে মিঠামইন থেকে ইটনা যাই। সেই পর্যটক আকর্ষক রাস্তায় কয়েকটি মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং সরকারি দপ্তরের জিপ ছাড়া কোনো যানবাহন পাইনি। হাওরের বুকবরাবর নির্মিত অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশবাদীদের গালাগালি করে বিভিন্ন ব্যানার সাঁটানো রয়েছে। এখন অবশ্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী যাকে হাওরের উন্নয়নের প্রাণপুরুষ আখ্যা দেওয়া হতো তিনিই বলছেন, ‘হাওরে আড়াআড়ি রাস্তা নির্মাণ করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি।’

শুধু কি রাস্তা? হাওরকে আমরা হাওর হিসেবে দেখতে চাইনি। হাওরকে শহরের মতো গড়ে তোলার প্রয়াস থেকে বের হতে হবে। বন্যা ও ব্যাপক জলাবদ্ধতা হলেই আমরা একটি ব্যাপার লক্ষ করি। তা হলো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন ও পাউবোর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল। এটি পুরোপুরি প্রহসন। সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান করতে হবে। সুরমার খনন, শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ, ছড়া-নালাসমূহকে সমন্বিত করে সুরমার সঙ্গে সংযুক্ত এবং তাতে স্লুইস গেট নির্মাণ ছাড়া সিলেট নগরকে বন্যা ও জলাবদ্ধতামুক্ত করা যাবে না।

  • পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক। অধ্যাপক ও উপাচার্য, সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা