সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪ ১৪:৫৫ পিএম
শখের বশবর্তী হয়ে কেউ চিকিৎসকের দারস্থ হয় না। ভুল চিকিৎসা কিংবা
চিকিৎসায় অবহেলায় দেশে প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ‘ভুল চিকিৎসায় দীর্ঘ হচ্ছে
লাশের মিছিল’ শিরোনামে ৬ জুন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত খবরে ফের যে চিত্র উঠে
এসেছে, তাতে আমরা শুধু উদ্বিগ্নই নই, ক্ষুব্ধও বটে। বলা হয়েছে চলতি মাসে শিশু, ৩ প্রসূতিসহ
দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণহানির পুনরাবৃত্তির
ঘটনা এই প্রশ্নও দাঁড় করায়, চিকিৎসার নামে নৈরাজ্যের অবসান হবে কবে? ভুল চিকিৎসা কিংবা
অবহেলার কারণে ক্রমাগত প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি শুধু মানুষের
আস্থার সংকটই প্রকট হচ্ছে না, জীবনঝুঁকির মাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। ওই প্রতিবেদনেই আরও
বলা হয়েছে, নিয়ম না মেনেই পুশ করা হচ্ছে বিভিন্ন ইনজেকশন ও স্যালাইন, যার ফলে রোগমুক্তির
পরিবর্তে মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটছে।
বিগত ছয় মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরপর কয়েকটি প্রাণহানির
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা প্রতিশ্রুতি
ব্যক্ত করেছিলেন, এ রকম ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এ-ও বলেছিলেন, ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পাওয়া গেলে অথবা চিকিৎসায় অবহেলা ধরা পড়লে প্রকৃত
দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে চিকিৎসা
চালাতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বিগত ছয় মাসে প্রতিশ্রুতির কতটা প্রতিপালন হয়েছে, এ নিয়েও
সঙ্গতই প্রশ্ন দাঁড়ায়। যদি যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত হতো, তাহলে হয়তো এমন মর্মন্তুদ
ঘটনার মুখোমুখি হতে হতো না। আমরা জানি, দেশের স্বাস্থ্য খাতে অনেক ক্ষত থাকলেও এর উপশমে
দায়িত্বশীলদের অঙ্গীকার যতটা প্রতিফলিত হয়েছে, বাস্তবে কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে, এই
প্রশ্নের উত্তর প্রীতিকর নয়। আমাদের স্মরণে আছে, কয়েক মাস আগে বাড্ডার সাতারকুলের ইউনাইটেড
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনার পর মারা যাওয়া শিশু আয়ানের মর্মস্পর্শী ঘটনা দেশব্যাপী
তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
আমরা দেখছি, অস্ত্রোপচারের পর শৈল্য চিকিৎসার উপকরণ দেহে রেখেই রোগীর
অস্ত্রোপচারের স্থান সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। এমন একাধিক ঘটনার পর চিকিৎসকের দায় ও চিকিৎসাপদ্ধতি
নিয়েও ইতোমধ্যে কম প্রশ্ন ওঠেনি। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু
বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতির অভিযোগ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। একজন চিকিৎসকের কাছে যখন
রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে যান, তখন চিকিৎসকের মানবিক দায়ের বিষয়টি যেমন অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে,
সমভাবেই রোগীর আস্থার বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, চিকিৎসায় অবহেলা শুধুই অস্ত্রোপচার-সংশ্লিষ্ট
নয়, এর বাইরে আরও উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যায়। রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা কিংবা
অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিয়ে এ থেকে কমিশন প্রাপ্তি, ভুল ওষুধ দেওয়া,
মৃত রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা, সরকারি হাসপাতালে রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা না দিয়ে প্রাইভেট
ক্লিনিক কিংবা চেম্বারে পাঠানো, পরীক্ষাসংক্রান্ত ভুল রিপোর্ট এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
কম ঘটেনি। নিকট অতীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধানেই উঠে এসেছিল কীভাবে ওষুধ কোম্পানির
কাছ থেকে চিকিৎসকরা কমিশন কিংবা অন্য ধরনের উপঢৌকন নিয়ে নিজেদের লাভালাভের অঙ্ক কষে
রোগীকে সর্বস্বান্ত করেন। তবে এই অভিযোগ ঢালাও নয়।
তারপরও নিশ্চয়ই প্রশ্ন থেকে যায়, কতজন চিকিৎসক মানবিক দায়িত্ববোধকে
প্রাধান্য দিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। সেবার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে ‘বাণিজ্য’ই মুখ্য
হয়ে উঠেছে। বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা প্রাইভেট ক্লিনিক তো বটেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি
হাসপাতালেও অরাজকতা জিইয়ে আছে। জনস্বাস্থ্যের সংকট পুঁজি করে এমন তুঘলকি কাণ্ড অন্য
কোনো সভ্য কিংবা মানবিক সমাজে চলে কিনা আমাদের জানা নেই। সাধারণ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত
ব্যক্তিরাও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে চলে যান। বিষয়টি শুধু আস্থার সংকট
হিসেবেই গণ্য নয়, আরও বহুমাত্রিক উপসর্গ চিহ্নিত করে।
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষকে চিকিৎসাসেবা সংকটে
ভুগতে হচ্ছে। তাদের সাধ্য নেই উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোনো পথ অবলম্বন করার। সরকারি
ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বিশ্বের উন্নত দেশ তো বটেই অনেক উন্নয়নশীল এমনকি
অনুন্নত দেশেও তা সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ মৌলিক অধিকারভুক্ত বিষয় এবং এর প্রতিপালনে তারা
যথেষ্ট সজাগ। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি আমাদের দেশেও মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বটে
কিন্তু এর প্রতিপালন-চিত্র কতটা প্রশ্নবিদ্ধ, এটি বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে না। চিকিৎসা
নিতে গিয়ে যদি রোগীর জীবনই ঝুঁকির মুখে পড়ে কিংবা তা হয় মৃত্যুর কারণ, তাহলে শুধু চিকিৎসকের
দক্ষতা কিংবা অবহেলা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে না; একই সঙ্গে প্রশ্ন দাঁড়ায় শুধু ভুল নয়, বরং
এটি অবহেলার কারণে সৃষ্ট। এমনটি কোনোভাবেই চলতে পারে না।
দেশে দক্ষ চিকিৎসক কিংবা ভালো ওষুধ নেই, তা তো নয়। আমরা জানি, ওষুধ
রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান আশাজাগানিয়া। কিন্তু এর বিপরীতে এ-ও দৃশ্যমান, নকল কিংবা
ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। জীবনবিনাশী এমন অনেক কর্মকাণ্ডই সরকার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
মহলের অজানা নয়। বিস্ময়কর হলো, এর পরও প্রতিকার-প্রতিবিধানের নজির আশানুরূপ নয়। আমরা
জানি চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা মানবতা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। চিকিৎসকদের
অনেকেরই স্বেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা কিংবা মহলবিশেষের অর্থলোভ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে,
তা এক কথায় নৈরাজ্য বৈ কিছু নয়। চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি কতটা ব্যয়বহুল তা-ও নতুন করে
বলার কিছু নেই। আমরা দেখেছি, এক একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে তারপর কিছুদিন তোলপাড় হয়।
অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতাল সিলগালা করা হয়। কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে না যেতেই ফিরে আসে পূর্বাবস্থা!
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কখনও কখনও ‘টোটকা দাওয়াই’ দিয়ে কিংবা
জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে শুধু প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেই দায় শেষ করতে চায়। স্বাস্থ্যসেবায়
সরকারের নিরলস প্রতিষ্ঠার বিপরীতে স্বেচ্ছাচারীতায় কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় জীবনের
যে সর্বনাশ ঘটছে, তা কোনোভাবেই প্রতিকারহীন থাকতে পারে না। ভুল চিকিৎসা ও অবেহলার কারণে
প্রাণহানির যে ঘটনাগুলো ঘটছে এর দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করতেই হবে। একই সঙ্গে
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোও সময়ের দাবি। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে সুশাসন
নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ‘ব্যবসায়িক লাভের’ আশায় যারা হীনস্বার্থ হাসিলে তৎপর,
তাদের প্রতি কোনো অনুকম্পা প্রদর্শন করা যাবে না। আমরা মনে করি, মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের
দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে অমানবিকতার ছায়া প্রলম্বিত
হতেই থাকবে। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।