× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

‘আহত’ অর্থনীতির দাওয়াই

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪ ১৪:৫৩ পিএম

‘আহত’ অর্থনীতির দাওয়াই

‘পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এটা একটা বাজেট; কারণ এর মধ্যে অনেক সংখ্যা আছে।’Ñজর্জ ডব্লিউ বুশ

প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সম্ভবত অন্যান্য অর্থমন্ত্রীর চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি ভাগ্যবান ছিলেন। এর কারণ দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ভূরাজনীতি, অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ সম্পদের জোগান ইত্যাদি উন্নয়নবান্ধব উপাদান মোটামুটি বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল। বস্তুত বাংলাদেশে ‘বড় আকারের বাজেট’, ‘ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’, দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস তার আমলের উপহার। এক কথায়, তথাকথিত ‘উচ্চাভিলাষী’ বাজেট দেওয়ার প্রত্যয় ও পরিবেশ তখন ছিল। পরবর্তীকালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থনীতির হাল ধরার পরপরই বিশ্ব পড়ল করোনার করালগ্রাসে; বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল দেশের অর্থনীতি। তা-ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলল কিছুদিন। কিন্তু যখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এলো, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াল। বেচারা অর্থমন্ত্রী তার পারদর্শিতা প্রদর্শন করার সময় ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।

এবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করলেন একাশি বছর বয়সি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলি এমপি। বাংলাদেশের ৫৪তম, বর্তমান সরকারের টানা চতুর্থ কিন্তু মাহমুদ আলির প্রথম বাজেটের শিরোনামÑ ‘সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার।’ তিনি এমন এক সময় বাজেট পেশ করলেন যখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতির জন্য অর্থনীতি ইতোমধ্যে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় বলে, ‘আমিও মাঝি হলাম, গাঙও বাঁকা হলো’, আস্থা যেন অনেকটা তেমনি। তবে অতীতের কিছু নীতিগত ভুলের সংশোধন; যেমনÑ সুদের হার, বিনিময় হার নমনীয় রাখা ইত্যাদি তার জন্য বোনাস বৈকি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে হয়তো তিনি নতুন কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক, কূটনীতিক, সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বড়। কিন্তু ওই যে একটু আগে বললাম, অর্থমন্ত্রীদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপারটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

দুই.

যে কটি মূল সমস্যা সামনে রেখে তার মন্ত্রণালয়কে আসছে অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেট প্রস্তুত করতে হয়েছে, তার মধ্যে আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা, রিজার্ভ হ্রাস ও আর্থিক খাতের নাজুক পরিস্থিতি। এগুলোর প্রভাবে বহুদিন ধরে অর্জন করা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ার প্রান্তে পতিত। বর্তমান সরকার এবার ক্ষমতায় এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে ভেবেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলÑ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি। তারা আরও আশ্বস্ত করেছিলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের সহ্যসীমা শূন্য (জিরো টলারেন্স) অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। তবে পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ব্যাপক ও বিস্তৃত দুর্নীতি অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। দুর্নীতির জন্য নাকি আমাদের জিডিপির ২-৩ ভাগ হাতছাড়া হয়। বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার এবং অপেক্ষাকৃত কম রাজস্ব আয় বড় মাপের ঋণখেলাপি এই আগুনে আবার ঘি ঢালছে। এসব বিষয়ে অতীতের মতো এবার সুচিন্তিত এবং কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়াস লক্ষ করা যায় না।

 

তিন.

করোনার আগ পর্যন্ত মূল বাজেটের আকার ক্রমাগত বাড়ছিল ১০-১২ শতাংশ হারে। কিন্তু ২০২৪-২৫ বাজেটের আকার গতবারের তুলনায় প্রান্তিক কম হয়ে প্রায় আট লাখ কোটি টাকা (জিডিপির ১৪ শতাংশ)। রাজস্ব আদায় পাঁচ লাখ কোটি টাকার ওপর, যার একটা বড় অংশ যাবে শুধু সুদ পরিশোধে। যেহেতু মূল্যস্ফীতির হার সাত শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সরকারের প্রধান টার্গেট, তাই আপাতদৃষ্টে এই ‘সংকোচনমূলক’ বাজেট কাম্য ছিল। তবে সরকার মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সাড়ে ছয় শতাংশের মতো, অথচ গত বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি। আবার ভর্তুকি কমানোর নামে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিতে পারে। তাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা বিদ্ধ হতে পারে কিন্তু ওই যে বলে, ‘উপায় নেই গোলাম হসেন’। একই সাথে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাত শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার চিন্তাও সুবিবেচনার পরিচায়ক। আরও মূলত দুটো কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার বড় করা হয়নি বলে মনে হয়। প্রথমত, ব্যয় নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণগ্রহণের অবকাশ নানা কারণে কমে গেছে যার বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই জায়গা সংকুলানের স্বার্থে। এমনিতেই অত্যধিক ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে দেশ, ইদানীং বাকির খাতায় নাম লেখাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সব ধরনের ব্যয় কমাতে হবে যখন অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির অন্যতম শক্ত নিয়ামক বলে শনাক্ত করা হয়। তবে সেই ব্যয় সংকোচন শুধু আমদানি কমিয়ে হবে না, প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদের আকার ছোট করতে হবে; মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের চলমান ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে। বাজেট বক্তৃতায় তেমন আভাস আমরা পেয়েছি বলে মনে হয় না।

 

চার.

প্রস্তাবিত বাজেটে খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষিতে ভর্তুকি এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকার কর্তৃক দেয় ভর্তুকির সিংহভাগ রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা চেটেপুটে খায় বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং পুরো ভর্তুকি প্রক্রিয়ার ফোকাসে পরিবর্তন আনা উচিত ছিল অত্যন্ত জরুরি, যাতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠী প্রবেশগম্যতা পায়। কৃষি খাতে গুরুত্ব প্রদান প্রশংসার দাবি রাখে। সীমিত সম্পদের মধ্যেও প্রশাসনিক এবং বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে আরও অধিক বরাদ্দ কাম্য ছিল। তবে বরাদ্দ বৃদ্ধি যেমন দরকার, তেমনি দরকার অপচয় রোধ এবং দুর্নীতি হ্রাস। মোট কথা অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে কথিত খাত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি বাজেটে দেয় বরাদ্দের চেয়ে আরও বেশি বরাদ্দ দাবি করে।

 

কিছু কিছু উদ্যোগ যেমনÑ সবার জন্য খাদ্য, খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতির উন্নতি, গ্রামের আধুনিকায়ন, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ, এমনকি সুনীল অর্থনীতি উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি নবধারামূলক এবং আকর্ষণীয় বলে প্রতিভাত হয়। তবে কালোটাকা সাদা করার ‘অনৈতিক’ এবং অনেকটা অকেজো পদক্ষেপ না নিয়ে অন্য পথেও হাঁটা যেত হয়তো। সাদাটাকার আয় দেবে ৩০ শতাংশ কর, অথচ কালোটাকা দেবে ১৫ শতাংশ করে। প্রশ্ন দাাঁড়ায় এটা কেমন বিচার?

 

পাঁচ.

বিভিন্ন খাতে কর রেয়াতের পরিমাণ কমিয়ে আনা, প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেওয়ার প্রচেষ্টা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস এবং শুল্ক কাঠামো যথাযথ করে রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাবিত পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। বিশেষত, যখন নির্দিষ্ট কিছু শিল্প দশকের পর দশক কর রেয়াত পেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে এবং দেশের বিত্তবান গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ করের আওতায় নেই। সংসদ সদস্যদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি বন্ধ করে করারোপ করা যথাযথ। কিন্তু দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের জন্য সরকার যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে তা পুনরুদ্ধারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতির এবং রোড ম্যাপের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে প্রস্তাবিত পদক্ষেপেও খুব একটা ধার আছে বলে মনে হয় না। এক হিসাবে জানা যায়, আমাদের জিডিপির প্রায় ৪০ ভাগ আন্ডার গ্রাউন্ড অর্থনীতিতে ডুবন্ত। একে সাদা করার উপায় বের করতে পারলে অর্থের অভাব কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু এ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অব্যাহত থাকা দরকার ছিল।

নিঃসন্দেহে প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ সালের বাজেট একটা সংকোচনমূলক, বাস্তবধর্মীÑ যা বাস্তবায়নযোগ্য। কিন্তু পুডিঙের স্বাদ খাওয়াতে, দেখাতে নয়। আসল কথা অর্থনীতি চালায় রাজনীতি। তাই রাজনৈতিক দূরদর্শীতা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহির বিকল্প নেই। বাজেট প্রণয়ন করা হয় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির নিরিখে, ক্ষমতাসীনদের অভিপ্রায়ের খাতিরে। সুতরাং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যথার্থই বলছেন, ‘অর্থমন্ত্রীর পক্ষে রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, কিন্তু অর্থনীতির জন্য এটা প্রয়োজন। গত নির্বাচনে যারা সরকারের পাশে ছিলেন, তারা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবেন…অর্থমন্ত্রীকে অর্থনৈতিক চাহিদা এবং বড় খেলোয়াড়দের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। বাজেটের সাফল্য কেবল এই ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করবে।’

 

ছয়.

এক কঠিন সময় পার করছে দেশ। এখন লৌহহস্তে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে চড়া মাশুল গুনতে হতে পারে অচিরেই। আমরা অর্থাৎ আমজনতা অর্থের অভাব দেখছি না, দেখছি এই অর্থ আহরণে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতি, প্রযুক্তি এবং প্রণোদনার ঘাটতি। দেখা যাক, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ নিয়ন্ত্রণে এবারের বাজেট কতটা সফলকাম হয় এবং আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ কতটা স্বস্তি পায়। ফিঙ্গারস ক্রসড।

আমাদের অর্থনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করব। তিনি বলেছেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা,/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে/নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,/দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’


  • অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা