× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাসান আজিজুল হক : সাহিত্যের নক্ষত্র

মামুন রশীদ

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২২ ০০:১৭ এএম

আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৫২ পিএম

হাসান আজিজুল হক, ছবি : সংগৃহীত

হাসান আজিজুল হক, ছবি : সংগৃহীত

এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিম ঝক ঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে। হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুপাশের বনবাদাড় আর ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-উ-উ চিৎকার ওঠে। ঈশেন কোণ থেকে ধর ধর লে লে শব্দ আসে, অন্ধকারে-ভূত অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে, চাঁদের আলো আবার ঝিলিক দেয় টিনের চালে। গঞ্জের রাস্তার ওপর উঠে আসে ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগি নিয়ে। ডানা ঝামরে মুমূর্ষু মুরগি ছায়া ফেলে পথে, নেকড়ের মতো ছায়া পড়ে শিয়ালটারও, চাঁদের দিকে মুখ তুলে চায় সে, রাস্তা পেরোয় ভেবেচিন্তে, তারপর স্কুলের রাস্তার বাদাড়ে ঢোকে। হাতে লাঠি চাঁদমণির বাড়ির লোক ঠ্যাঙাড়ের দলের মতো হল্লা করে রাস্তায় পড়ে, কোনদিকি গেল শালার শিয়েল, কোনদিকি ক দিনি।

আরো হিম নামে।

এই হিম নামার ভেতর দিয়ে, পুরো শরীর ও মনকে অবশ করে তোলার ভেতর দিয়ে চেতনাকে জাগিয়ে তোলার যে গল্পকার, তিনি হাসান আজিজুল হক। ওপরে উদ্ধৃত গল্পটি পড়েছিলাম আমার আঠার-বিশ বছর বয়সে। মাত্র আটটি গল্প নিয়ে মলাটবদ্ধ হওয়া বই ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। বাংলা সাহিত্যে তার অনন্য আসন। 

হাসান আজিজুল হক লিখতে শুরু করেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। শুরু থেকে তিনি মানুষ ও সমাজের প্রতি যে দায়বদ্ধতা নিয়ে লেখায় মনোযোগী হন, তা থেকে কখনই বিচ্যুত হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ ও মানুষের প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা, তিনি সেই ঋণ শোধের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার লেখাকে। লেখার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মনোজগতের ছবি এঁকেছেন, মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ, দুর্দশাকে ভাষারূপ দিয়েছেন। হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। পরবর্তীকালে তাদের পরিবার দেশত্যাগ করে চলে আসেন আজকের বাংলাদেশে। দেশভাগের বেদনা, জন্মভূমি ছেড়ে আসার বেদনাকে তিনি প্রতিপদে অনুভব করেছেন। ফলে তার গল্পে দেশত্যাগী মানুষের যন্ত্রণা, তাদের সংগ্রাম, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, জীবনযাপনের কথা উঠে এসেছে নিপুণভাবে।

রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় হাসান আজিজুল হকের লেখা ‘শকুন’ শিরোনামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত গল্প। প্রায় সাত দশকের লেখক জীবনে প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’। এরপরে ছোটগল্পের বই ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে-'আমৃত্যু আজীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, 'পাতালে হাসপাতালে' । দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। 

রাঢ়বঙ্গের কথাকার হাসান আজিজুল হক তার করবীগাছকে যেমন দেশভাগের অভিঘাতে অভিশপ্ত এক বৃদ্ধ এবং তার পরিবারের ভয়ংকর জীবনযাত্রার ভেতর দিয়ে প্রতীকায়িত করেছিলেন, তেমনি প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’র ভেতর দিয়েও তিনি অবিভক্ত বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের মানুষের অনাহার, সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগের বেদনাগুলোকে ধারণ করেই জীবনের কথা শুনিয়েছেন। যে বিষবৃক্ষ রয়ে গেছে, যার বীজ এখনও স্বপ্নের পরাজয় ডেকে আনতে সহায়ক। 

জীবনের অধিকাংশ সময় রাজশাহীতে কাটিয়ে দেওয়া বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ১৫ নভেম্বর ২০২১, রাত নয়টায় রাজশাহী শহরে নিজ বাসভবনে মারা যান। শেষ ঘুমেও তিনি ঘুমিয়ে আছেন পদ্মাপাড়ের শহর রাজশাহীতে। এখানে থেকে যাওয়া প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা করেই অন্য কোথাও যাইনি। আমরা সবাই যদি ঢাকায় চলে আসি, তাহলে জনপদগুলো বিরান হয়ে যাবে গো। তা করব কেন?’ ৮২ বছরের জীবনে হাসান আজিজুল হক নিজের লেখায় ছিলেন আপসহীন। আপসহীনতার কারণে নানা সময়ে হুমকিও পেয়েছেন। কিন্তু ভীত হননি। বরং জোর দিয়েছেন এই বলে যে, ‘কোনোভাবেই মানুষের কণ্ঠরোধ করা যাবে না।’ শুধু লেখাতেই নয়, জীবন, পেশা ও মননের শুদ্ধতা দিয়েও তিনি উঠেছিলেন ভিন্ন এক উচ্চতা-যা তার বিদায়েও ম্লান হয়নি। 


লেখক : কবি ও সাংবাদিক


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা