দুর্যোগ
ড. বিশ্বজিৎ নাথ
প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪ ০৯:৪০ এএম
ড. বিশ্বজিৎ নাথ
২৭ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের সব বিভাগে দমকা হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাত কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য জেলাসমূহে ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলগুলোয় অতিবৃষ্টি ঘটলে বরাবরই ভূমিধসের শঙ্কা দেখা দেয়। অতীতে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত ঘূর্ণিঝড়ে পাহাড়ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল এবং প্রাণহানির মর্মন্তুদ ঘটনাও ঘটেছিল। বাংলাদেশের ধসপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোণা ও সিলেট এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে কিছু পাহাড় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ১৫ হাজার ৮০৯ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ে ধসের ঘটনা বেশি ঘটে। মূলত পাহাড়ের জনবসতিপূর্ণ অংশে পাহাড়ধস যেন বার্ষিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এসব পাহাড়ে ধসের কারণে প্রচুর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে অতীতের মর্মস্পর্শী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়ধস নিয়ে আমাদের আগে থেকেই ভাবতে হবে।
অতিবৃষ্টি কিংবা ভারী বৃষ্টিপাত পাহাড়ধসের অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু কতটুকু বৃষ্টি
হলে পাহাড়ধস ঘটবে তার একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা
নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে গবেষণা করে পাহাড়ধসের কারণগুলো খতিয়ে বের করেছেন। এখন পর্যন্ত
আমাদের গবেষণা অনুসারে, টানা চার-পাঁচ দিন ৩০, ৪০, ৫০ এবং অবস্থাভেদে ৬০ মিলিমিটারের
ওপরে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। কোনো প্রাকৃতিক
দুর্যোগের সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি হলে নিশ্চিতভাবেই ধরে
নেওয়া যায় ভূমিধস হবে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সময়ও আমরা একই চিত্র দেখেছি। ঘূর্ণিঝড় রেমালের
সময়ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা আমাদের এমন বার্তা দিয়েছে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু
পার্শ্ববর্তী প্রভাব থাকে। ঘূর্ণিঝড় যখন এগিয়ে চলে তখন তার সঙ্গে মেঘপুঞ্জও এগিয়ে চলে।
পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিও যুক্ত হয়। বাতাসের গতিও এ ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাতের
পরিমাণ বাড়াতে পারে। বিশাল জলরাশির সঙ্গে মেঘমালা একত্র হয়ে স্থলভাগে ব্যাপক নেতিবাচক
প্রভাব ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় মেঘমালার গতি কম থাকে। স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায়
মেঘমালা চলাচল করার সময় বেশি বাধা পায় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। মেঘমালা পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত
হয়ে আরও পুঞ্জীভূত হয় এবং ভারী বৃষ্টিপাত ঘটায়। ওই সময় পাহাড়ধসের শঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।
অভিযোগ আছে, গত তিন দশকে কেবল চট্টগ্রামেই ৩ শতাধিক পাহাড় কাটা
পড়েছে। বেশিরভাগ কাটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার
ও প্লট তৈরি করে বসত নির্মাণÑএ দুটিকেই পাহাড়ধসের মানবসৃষ্ট কারণ বলে অভিহিত
করা হয়। প্রথমেই বলেছি, বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড়ধস হয় এমন নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশেষ
অবস্থার পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণও এখানে বড় প্রভাব ফেলে। পাহাড়ে গাছ কেটে উজাড় করে
ফেলা, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে জনবসতি স্থাপন, পাহাড়ের প্রাকৃতিক কাঠামো না বুঝে চাষজমি
তৈরি এবং পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ ইত্যাদি পাহাড়ধসের ঝুঁকি বাড়ায়। আমরা দেখছি, জনসংখ্যাবহুল
এ দেশে বাসস্থান ও খাদ্যসংস্থানের জন্য অনেকেই পাহাড়ে ঘন জনবসতি গড়ে তুলছে। এ জনবসতি
গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা ঝুঁকি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়
তারা এ ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হয় বটে, কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময় ঝুঁকির মধ্যেই
বসবাস করে। পাহাড়ের তদারকিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়া এবং সেখানে জনবসতি স্থাপনের
ক্ষেত্রে দুর্যোগপ্রতিরোধী প্রকৌশল ও অবকাঠামো নির্মাণে অমনোযোগ প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বাড়িয়ে
চলেছে। এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের এখন ভাবার সময় এসেছে।
পাহাড়ি জনপদের অনেকেই জানেন না কোন পাহাড়ের ঢাল কতটুকু। প্রাকৃতিক কাঠামো অনুসারে
কোন ঢালের পাহাড় জনবসতি গড়ে তোলার অনুপযুক্ত, এ বিষয়েও কারওই ধারণা নেই। পাহাড়ে বনভূমি
রক্ষায় বন অধিদপ্তরকে তাই বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ে যত্রতত্র জুমচাষ
বন্ধেও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। জুমচাষের ফলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক কাঠামোর ক্ষতি হয়। এজন্য
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘালঘু জাতিসত্তার মানুষদের আধুনিক চাষাবাদে উৎসাহী করে তুলতে
হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক কাঠামোর ওপর বড় অভিঘাত পড়বে। পাহাড়ি
জনপদের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা প্রাকৃতিক কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির বৈজ্ঞানিক কারণ
সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা জানে না বলেই নিজেরাও ঝুঁকির মধ্যে দিনযাপন করছে। পাশাপাশি
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষতির শঙ্কা বাড়ছে। তাই পাহাড়ধসের বিষয়টিতে আগে
থেকেই পর্যালোচনা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকতে হবে।
আমরা জানি, বর্ষাকালে পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ধসের শঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। বছরে অন্তত
দুয়েকবার এ শঙ্কা তীব্র হয়ে ওঠে। এসব বিষয় আমলে রেখে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু এ মুহূর্তে
আবহাওয়া পর্যালোচনায় আমাদের বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যালোচনার
ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই পিছিয়ে। এখনও এক সপ্তাহব্যাপী আবহাওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য
বাইরের কোনো তথ্যসূত্রের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। আবহাওয়া পর্যালোচনা কিংবা দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দেশে আবহাওয়া গবেষকদের এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত
সহযোগিতা দেওয়া হয় না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা আবহাওয়া গবেষক প্রতিনিয়ত প্রচুর তথ্য-উপাত্ত
সংগ্রহ করেন। তাদের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পরবর্তী এক সপ্তাহের এমনকি দুর্যোগ
চলাকালীন আবহাওয়া পর্যালোচনা করে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য
সরবরাহ এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। গবেষকরা তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো
ডেটা সেন্টারের অভাবে ভোগেন। এ তথ্য গবেষকদের পাওয়াই যেখানে কঠিন সেখানে যেকোনো সাধারণ
মানুষের জন্য খুঁজে বের করা দুষ্করই বটে। পূর্ববর্তী দুর্যোগের কোনো তথ্যভান্ডার কিংবা
আর্কাইভের অভাবও দীর্ঘদিনের। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও আবহাওয়াবিদরা প্রতিনিয়ত তথ্য-উপাত্ত
সংগ্রহ করে চলেছেন। কিন্তু তাদের এ তথ্য যথাসময়ে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের
অনাগ্রহ রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে একাধিক মন্ত্রণালয় সংযুক্ত হয়ে পড়ে। আবহাওয়া
অধিদপ্তর, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এখানে যুক্ত
থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কেও নানাবিধ পদক্ষেপ নিতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক
পর্যায়ে এসব তথ্য কারা ব্যবহার করবে এ নিয়েও দ্বিধা দেখা দেয়। অথচ আবহাওয়ার পূর্বাভাসের
তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়মূলক সমন্বয় গড়ে তোলা জরুরি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা যেকোনো শঙ্কার ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ
এবং তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে মর্মন্তুদ ঘটনা এড়ানো সহজ হয়। অথচ এ বিষয়ে এখনও
দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুর্যোগ এবং আবহাওয়া সম্পর্কিত পূর্বানুমানের ক্ষেত্রে
আমাদের কাঠামোগত সক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে।
কিন্তু সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে। পাহাড়ধস দেশের পার্বত্যাঞ্চলের জন্য বড় সংকট। এ দুর্যোগের
বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই ভাবনা জরুরি। পাহাড় সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের
রয়েছে বাড়তি দায়দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে
সংকট কাটবে না। বরং বাড়বে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়াবিদদের গবেষণার পৃষ্ঠপোষকতা
বাড়ানো জরুরি।
আবহাওয়ার গতিবিধির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেও আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলা করার সক্ষমতা অনেকাংশে বাড়বে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞাননির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবিলার পদক্ষেপ নেওয়া হলে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও চৌকশ হয়ে উঠবে। ক্ষণে ক্ষণে আবহাওয়া তার খেয়ালমর্জি পাল্টাতে শুরু করেছে। এমন সময়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞাননির্ভর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দিকেই আমাদের এগোতে হবে। সমন্বয় এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বলেই মনে করি। সমন্বয়ের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলি। আমাদের সক্ষমতা রয়েছে আবহাওয়ার গতিবিধি অনুমান করে নাজুকতা কমানোর। সেদিকেই আমাদের এগোতে হবে।