গবেষণা
ড. মইনুল হাসান
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪ ০৯:৩২ এএম
ড. মইনুল হাসান
নাম টমাস, বয়স ৩৩ বছর। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তার শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। জাঁদরেল চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞ সবাই একমতÑমারাত্মক আহত টমাসকে বাঁচানো সম্ভব নয়। অথচ সাত মাস পরে পুরোপুরি সুস্থ তরুণ টমাস হাসপাতাল ছেড়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে বাড়ি ফিরে আসেন। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সের পশ্চিমে ন্যান্তে, বাড়ির সঙ্গে বাগানে রাখা পুরোনো নৌযানের ট্যাংক থেকে জ্বালানি তেল নিষ্কাশনের সময় অসাবধানে আগুন লেগে গেলে মুহূর্তেই ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়। ফলে আগুনে খুব বিশ্রীভাবে পুড়ে যান টমাস। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার বাড়ির পুকুরে লাফিয়ে পড়েন। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর জানা যায় টমাসের শরীরের ৮৫ শতাংশ ত্বক পুড়ে গেছে। ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ত্বক পুড়ে গেলেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে চারজন চিকিৎসক, তাদের শেষ কথাÑ৮৫ শতাংশ ত্বক পুড়ে যাওয়ার মানেই হলো মৃত্যু, দুর্ভাগা মানুষটিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। অন্তত তাদের বহুদিনের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
টমাসের শরীরের নিচের দিকের ত্বকের
এপিডার্মিস ও ডার্মিস দুটি স্তরই দগ্ধ হয় অর্থাৎ থার্ড ডিগ্রি বার্ন। শরীরের
ওপরের দিকের ত্বক পুড়ে গেলেও ততটা গভীরে পৌঁছাতে পারেনি। টমাস বয়সে তরুণ, কোনো অসুখবিসুখ
নেই, স্বাস্থ্য ভালো। সবার চোখের সামনে মানুষটির অসহায় মৃত্যু হবে, তা মেনে নেওয়া
যায় না। প্রফেসর পেরো এবং তার দল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন টমাসকে বাঁচানোর জন্য তারা
চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবেন না। তারা অতি অসম্ভব সম্ভব করার সংকল্প করলেন। টমাস জ্ঞান
হারাননি। নিবিড় পরিচর্যায় থেকেও ডাক্তারদের সব কথাই শুনছিলেন। তিনিও অকালমৃত্যু মেনে
নিতে মোটেই প্রস্তুত নন। প্রফেসর পেরো ঠিক করলেন মাথার তালুতে যেটুকু ত্বক অক্ষত আছে
তা থেকে কিছুটা নিয়ে চামড়া শরীরের নিচের দিকের অংশগুলোয় সংস্থাপন করবেন। ক্ষতস্থান
দ্রুত সারিয়ে তোলার এবং সংস্থাপিত ত্বকের কোষগুলোর দ্রুত বৃদ্ধির জন্য অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তের
সার্বক্ষণিক সঞ্চালনের প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে, মানুষের রক্ত দিয়ে তা হওয়ার নয়।
প্রফেসর পেরোর মনে পড়ল ফরাসি জীববিজ্ঞানী ড. ফ্রাঙ্ক জালের কথা।
ড. জাল প্রায় দুই যুগ ধরে গবেষণা
করছেন সমুদ্রতীরের জোয়ারভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসবাসকারী এক প্রজাতির কেঁচো নিয়ে। নাম : অ্যারেনিকোলা
মেরিনা। ড. জাল লক্ষ করলেন ভাটার সময় সমুদ্রের পানি যখন নেমে যায় এবং পরবর্তী জোয়ার
না আসা পর্যন্ত সময়টুকু শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রেখে দিব্যি শারীরবৃত্তীয় কাজ চালিয়ে যেতে
পারে এ বিশেষ প্রজাতির কেঁচো। দীর্ঘ সময় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রেখে মেরুদণ্ডহীন এ প্রাণীটি
কীভাবে বেঁচে থাকে, তা জানতে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি দেখলেন এর রহস্য লুকিয়ে আছে এ প্রাণীটির রক্তে।
সামুদ্রিক কেঁচোর রক্তে কী আছে? সামুদ্রিক কেঁচোর
রক্তে আছে মানুষের রক্তের চেয়ে উন্নত হিমোগ্লোবিনসদৃশ অণু। রক্তের লোহিত কণিকায়
থাকা হিমোগ্লোবিন একটি প্রোটিন, যার ওপর ভর করে রক্তের মাধ্যমে সমস্ত কোষে পৌঁছে যায়
অক্সিজেন। সোজা কথায় হিমোগ্লোবিন হচ্ছে অক্সিজেন অণু বহনকারী বাহন। জীবনধারণের
জন্য অক্সিজেন আমাদের একান্ত প্রয়োজন। অক্সিজেন ছাড়া আমাদের বাঁচার কোনোই উপায়
নেই। মানুষের লোহিত কণিকার হিমোগ্লোবিনের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি অক্সিজেন ধারণে সক্ষম এ
সামুদ্রিক কেঁচোর হিমোগ্লোবিন। আর হিমোগ্লোবিন এমন বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন ধারণ
করতে পারে বলেই ভাটার পুরো সময়টা শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে মাটির নিচে কাটিয়ে দিতে
পারে। তাই সামুদ্রিক কেঁচোর রক্ত মানুষের জন্য রক্তের খুব ভালো বিকল্প হতে পারে।
কারণ এর আরও কতগুলো বিশেষ সুবিধা
আছে।
যেমন
১. সবাই রক্ত গ্রহণ করতে পারে। ২. সহজে
সংরক্ষণ ও পরিবহন করা যায়। নিম্ন তাপমাত্রায় জলীয় অংশ বের করে নিলে অর্থাৎ
লাইফিলাইসেশন পদ্ধতিতে শুকিয়ে পাউডার করে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রায় বহুদিন সংরক্ষণ
করা সম্ভব। অন্যদিকে মানুষের রক্ত ৪°সেলসিয়াসে
মাত্র ৪২ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। ৩. হিমোগ্লোবিন
ছোট আকারের হয়। ফলে মানবদেহে সঞ্চালনে বিশেষ সুবিধা রয়েছে। ৪. অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সংযোজন সহজ হবে। সংস্থাপনের
জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদি) সংরক্ষণে কেঁচোর রক্ত অনেক বেশি
কার্যকর অর্থাৎ সংরক্ষণ সময় বহুগুণ বৃদ্ধি করা যায়। যেমন দেহ থেকে ফুসফুস
বিচ্ছিন্ন করার পর অন্যের দেহে সংযোজনের জন্য মাত্র চার থেকে আট ঘণ্টা পাওয়া যায়।
সে ক্ষেত্রে কেঁচোর হিমোগ্লোবিন ব্যবহার করে এ সময়কে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বর্ধিত করা
সম্ভব। তেমনি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে এক দিনের স্থলে সাত দিন পর্যন্ত হাতে পাওয়া
যায়। চিকিৎসকরা হাতে বাড়তি সময় পেলে তাদের জন্য ট্রান্সপ্লান্টের কাজটি অনেকখানি
সহজ হয়। সংরক্ষণের সুবিধাজনক উপায় না থাকায় প্রতি বছর প্রায় অর্ধেক প্রত্যঙ্গ নষ্ট
হয় এবং বহু অর্গানপ্রত্যাশী রোগী প্রাণ হারায়। ৫. শ্বাসকষ্ট লাঘবে সহায়ক। যেসব রোগী
রক্তে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের অভাবে বা ফুসফুসের রোগের কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তাদের
কষ্ট লাঘবে কেঁচোর হিমোগ্লোবিন ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সেরিব্রাল হাইপোক্সিয়ায় (মস্তিষ্কে
অক্সিজেন ঘাটতি) আক্রান্তদের কেঁচোর রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
প্রফেসর পেরো ড. জালের গবেষণালব্ধ ফলাফলের খবর জানতেন। তিনি টমাসের ক্ষতস্থান সারিয়ে তুলতে এ বিশেষ প্রজাতির কেঁচোর রক্ত দিয়ে তৈরি জেল ব্যবহার করেন এবং অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন ত্বকের কোষগুলো দ্রুত সেরে উঠছে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। টমাস ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন। কেঁচোর মতো একটি অতি সাধারণ প্রাণীর অসাধারণ রক্তে নতুন জীবন লাভ করেন এ তরুণ। মানুষের রক্তের বিকল্প এ রক্তকে বলা হয় ‘সুপার রক্ত’। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর থেকেই মানুষের জীবন রক্ষায় কেঁচোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর রক্তের সঙ্গে আমাদের বেচেঁ থাকার সম্পর্ক। সময়মতো সঠিক গ্রুপের রক্তের অভাবে প্রাণহানির সংখ্যা খুবই ভয়াবহ। এ ভয়াবহতা আরও প্রকট স্বল্প আয়ের দেশগুলোয়। ড. জালের বৈপ্লবিক ও বিস্ময়কর আবিষ্কারকে অনেকেই স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন-জি আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করেন। একমাত্র পেনিসিলিন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে এবং সেই পথ ধরে এখনও রক্ষা পাচ্ছে কোটি কোটি প্রাণ। তেমনই কেঁচোর রক্ত বাঁচাবে বহু মানুষের প্রাণ।