প্রেক্ষাপট
ডা. মনিলাল আইচ লিটু
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪ ০৯:৩৭ এএম
আপডেট : ২৭ মে ২০২৪ ১৪:১৪ পিএম
আমাদের জৈবিক
ঘড়ি শরীরের ঘুম, তাপমাত্রা, হরমোন নিঃসরণ, স্মৃতিশক্তি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সবকিছুকে
নিয়ন্ত্রণ করে। এই জৈবিক ঘড়ির নিয়মমাফিক আবর্তনের ফলেই আমাদের ঘুম সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত
হয়। কিন্তু সঠিক ঘুমের অভাবে আমাদের অনেক বিপত্তি ঘটে যেমনÑ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস,
স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, সড়ক দুর্ঘটনা, মানসিক রোগসমূহ, অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদ, হার্টের
নানা রকম রোগÑ এগুলো মোটাদাগে ঘুমের সমস্যা ও নাক ডাকার ফসল। কাজেই আমাদের পর্যাপ্ত
ঘুমের প্রয়োজন। আসুন আমরা জেনে নিই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা।
ঘুম হলো দৈনন্দিন
কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ঘুমের সময় সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
স্তিমিত থাকে। ঘুম শরীরকে চাঙ্গা করে পরবর্তী দিনের কাজের জন্য আমাদের তৈরি করে। শারীরিক
ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। বয়স অনুযায়ী মানুষের
ঘুমের প্রয়োজনীয় সময় ভিন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের পরামর্শপত্র
অনুযায়ী ৬ থেকে ৯ বছর বয়সি শিশুদের রাতে অন্তত ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ১০ থেকে
১৭ বছর বয়সিদের ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সি মানুষের রাতে ৭-৯ ঘণ্টা
ঘুমানো প্রয়োজন। ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সিদের জন্য ঘুমানো প্রয়োজন ৭-৮ ঘণ্টা। অনেকেই
এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও সুস্থ থাকতে পারেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজি
ও নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক, ‘হোয়াই উই স্লিপ’ বইয়ের লেখক ম্যাথিউ ওয়াকার জানিয়েছেন,
ঘুম কম হলে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতার।
ঘুম কম হলে নতুন
স্মৃতি তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন ম্যাথিউ ওয়াকার। তিনি বলেন,
ঘুম কম হলে মস্তিষ্কে ‘বিটা অ্যামিলয়েড’ নামের ক্ষতিকর প্রোটিন তৈরি হয়। অ্যালঝাইমার
রোগের সঙ্গে এই প্রোটিনটির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীর মস্তিষ্ক
থেকে বিটা অ্যামিলয়েড ও এ রকম অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করে থাকে। কাজেই ঘুম
কম হলে অ্যালঝাইমার রোগ সৃষ্টিকারী এই প্রোটিনটি ও এ রকম ক্ষতিকর পদার্থগুলো মস্তিষ্কে
জমা হবে। আর যত দিন যাবে, ডিমেনশিয়া তৈরি হবে।
কম ঘুমের প্রভাব
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপরও পড়ে। মাত্র এক রাতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমালে
শরীরের ক্যানসারপ্রতিরোধী কোষগুলোর ৭০ শতাংশ মরে যায়। এভাবেই কম ঘুম তৈরি করে অন্ত্রের
ক্যানসার, প্রোস্টেটের ক্যানসার ও স্তন ক্যানসারের মতো নানা ধরনের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা
রয়েছে। এ সম্ভাবনা এতই বেশি যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেকোনো নাইটশিফটের কাজকে ক্যানসার
সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঘুম কম হলে শরীরের
রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার ওপরও খারাপ প্রভাব পড়ে। গভীর ঘুম রক্তচাপের প্রাকৃতিক চিকিৎসক।
কারণ গভীর ঘুমের সময় হার্টবিটরেট কমে আসে, রক্তচাপ নেমে যায়।
পর্যাপ্ত ঘুম
না হলে রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। ফলে রক্তচাপ বেড়ে
যায়। ঘুমের স্বল্পতা প্রাণঘাতী স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে
দেয়। ১.৬ বিলিয়ন মানুষের ওপর দুই বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, ডেলাইট সেভিং টাইম
চলাকালে যখন মানুষের ঘুমের সময় এক ঘণ্টা কমে যায়, তখন হার্ট অ্যাটাকের পরিমাণ ২৪ শতাংশ
বেড়ে যায়। টানা ১৬ ঘণ্টা নির্ঘুম কাটালেই মানুষ মানসিক ও শারীরতাত্ত্বিকভাবে ভেঙে পড়তে
শুরু করে। ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা টানা না ঘুমিয়ে থাকলে কারও মানসিক ও শারীরিক অবস্থা মাতালের
সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব কাটিয়ে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন দিনে গড়ে আট ঘণ্টা ঘুম।