সুফি মোস্তাফিজুর রহমান
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:৫৬ পিএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩৮ পিএম
উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম চিত্রশিল্প। মৃৎপাত্র, পাথর ও কাচের পুঁতিতে বিচিত্র চিত্রশিল্প ফুটে উঠেছে। উয়ারী-বটেশ্বরের মানুষ উন্নত শিল্পবোধ ও দর্শনের অধিকারী ছিল। প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বরের মানুষ অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বন্যামুক্ত প্লাইস্টোসিন ভূমিতে কিন্তু নদীর তীরে বসতি গড়ে তুলেছে।
উয়ারী-বটেশ্বর নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দুটি গ্রামের বর্তমান নাম। প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল নগরসভ্যতা। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল সেই সভ্যতার নগরকেন্দ্র। তবে শুধু বেলাব নয়; শিবপুর, রায়পুরা ও মনোহরদী উপজেলায় এ পর্যন্ত ৫০টি প্রত্নপীঠ আবিষ্কৃত হয়েছে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা নগরসভ্যতা একদিন ধ্বংস হয়। ঠিক দিনক্ষণ এবং কারণ জানা না গেলেও নগরসভ্যতা মাটির নিচে চাপা পড়েছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনুসন্ধিৎসু মোহাম্মদ হানিফ পাঠান ১৯৩০-এর দশকে কিছু ধাতব মুদ্রার সন্ধান পান। এরপরই খুঁজে পান কিছু লোহার হাতিয়ার। তাঁর মনে হয় এগুলো কোনো ফেলনা বস্তু নয়। খুব সম্ভব প্রাচীন মানবসভ্যতার নিদর্শন। উয়ারী-বটেশর অঞ্চলে জমি চাষ, গর্ত খনন প্রভৃতি গৃহস্থালি কাজে ভূমির মাটি ওলট-পালট হয়। প্রাচীন শিল্পবস্তু ভূমির ওপর চলে আসে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর পাথরের প্রত্নবস্তুগুলো চকচকে দেখায়। মোহাম্মদ হানিফ পাঠান সেগুলো সংগ্রহ করেন এবং লেখালেখি শুরু করেন।
১৯৫০-এর দশক থেকে প্রত্নবস্তু সংগ্রহ এবং গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন মোহাম্মদ হানিফ পাঠানের সুযোগ্য পুত্র আরেক স্কুলশিক্ষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। দীর্ঘ ৬০ বছর হাবিবুল্লা পাঠান উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে গবেষণারত আছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানের কথা এ দেশের বড় বড় অধ্যাপক, পণ্ডিত, ঐতিহ্যবিশারদ কানে নেননি দীর্ঘদিন। উপরন্তু কোনো কোনো সময় উয়ারী-বটেশ্বরের কথা বলতে গিয়ে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন। উয়ারী-বটেশ্বর দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকে। ১৯৯২ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী প্রাচীন বাংলাদেশ গ্রন্থে লেখেন—‘উয়ারী-বটেশ্বর কমপক্ষে বাইশশ বছর প্রাচীন। উয়ারী-বটেশ্বরে তৈরি হতো ক্রিস্টাল, অ্যাগেট, জেসপার, কার্নেলিয়ান, অ্যামেথিস্ট পাথরের পুঁতি। উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।’ এরপরও বাংলাদেশের পণ্ডিতরা উয়ারী-বটেশ্বরের প্রতি মনোযোগী হননি। ১৯৯৬ সালে পুণ্ড্রনগর নিয়ে পিএইচডি গবেষণা আরম্ভকালে প্রথম উয়ারী-বটেশ্বর পরিদর্শন করি। সেই থেকে উয়ারী-বটেশ্বর আমার দৃষ্টি কাড়ে। মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠানকে সঙ্গে নিয়ে পুরো এলাকা জরিপ শুরু করি। ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন একটি ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও বহুশাস্ত্রীয় জটিল কাজ।
বিভিন্ন সহৃদয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সীমিত আর্থিক সহায়তায় গবেষণা কাজ চলছে। আমার নেতৃত্বে ঐতিহ্য অন্বেষণের গবেষকরা উয়ারী-বটেশ্বর গবেষণায় অংশ গ্রহণ করছেন, সঙ্গে থাকছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গবেষণার শুরুতে একশ্রেণির পণ্ডিত ব্যক্তি আমাদের আবিষ্কারকে অস্বীকার করতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন মুসলিম যুগের পূর্বে চুন-সুরকির ব্যবহার ছিল না। মাটির এত ওপরে এত প্রাচীন প্রত্নবস্তু থাকতে পারে না। উয়ারী-বটেশ্বর নগর তো দূরের কথা, ওখানে মানববসতির চিহ্নও নেই। উয়ারী-বটেশ্বর আসলে মিথ, বাস্তবে ওখানে কিছু নেই। সুফি মোস্তাফিজুর রহমান হলো লাল সালুর মজিদ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতদের এ রকম আচরণে আমরা বিব্রত হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি কিন্তু হাল ছাড়িনি। তবে এ কথাও সত্য নিন্দুকের দলের চেয়ে সাহায্যকারীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তারা সীমিত অর্থ ও মনোবল দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী আমাদের সহায়তা করেছেন বিভিন্নভাবে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত Oxford Companion to Indian Archaeology গ্রন্থে ভারতবর্ষের প্রাচীন ৪১টি নগরের মধ্যে উয়ারী-বটেশ্বর ২ নম্বর ক্রমিকে এবং দুই বাংলার ১২টি নগরের মধ্যে উয়ারী-বটেশ্বর ১ নম্বর ক্রমিকে টেক্সট এবং মানচিত্রে উল্লেখ করেছেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্ক ২০০৯ সালে প্রকাশিত হিস্ট্রি অব বাংলাদেশের গ্রন্থে উয়ারী-বটেশ্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে।
আমাদের মাইলফলক আবিষ্কারসমূহ ও পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল উয়ারী-বটেশ্বরকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ইতোমধ্যে দাঁড় করিয়েছে। কার্বন-১৪ তারিখের মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বর আড়াই হাজার বছর প্রাচীন একটি দুর্গ-নগরের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনপদ শ্রেণির ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা ও উত্তরাঞ্চলীয় কৃষ্ণ মসৃণ মৃৎপাত্র প্রাপ্তি কার্বন-১৪ তারিখের মাধ্যমে নির্ণীত আড়াই হাজার বছর সময়কে সমর্থন করে। রোলেটেড মৃৎপাত্র ও স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতির আবিষ্কার উয়ারী-বটেশ্বরকে ভূমধ্যসাগর এলাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত করে। নবযুক্ত হাইটিন ব্রোঞ্জ নির্মিত পাত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বরের সম্পর্কের কথা বলে। নবযুক্ত মৃৎপাত্র ও নবযুক্ত ইট-নির্মিত বিশেষ ধরনের কুণ্ড বা পুকুর উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বৌদ্ধধর্ম চর্চার কথা বলে। এ অঞ্চলে অষ্টম শতকের বৌদ্ধ পদ্ম-মন্দির ও বৌদ্ধবিহারিকার আবিষ্কার দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিকশিত বৌদ্ধধর্ম চর্চার সাক্ষ্য বহন করে।
ধাতব অলঙ্কার, স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি একটি সমৃদ্ধ জনপদের পরিচয় বহন করে। উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চল ছিল লৌহিত্য জনপদ! উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ-নগর ছিল লৌহিত্য জনপদের রাজধানী। উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত বহুসংখ্যক ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা এবং নয়নাভিরাম বাটখারাসমৃদ্ধ বাণিজ্যের পরিচায়ক। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একটি নদীবন্দর। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল উয়ারী-বটেশ্বর। অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার চক্রবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর ও টলেমি উল্লিখিত সৌনাগড়াকে অভিন্ন মনে করেন। ২৩০০ বছরের প্রাচীন ৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বিশ্ববিখ্যাত সিল্ক রুটের সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বর সংযুক্ত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ভারতের বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হলে পূর্ব ভারতের গঙ্গাঋদ্ধি জাতি বা রাজ্যের শক্তিশালী সামরিক শক্তির কথা শুনে ভীত হয়ে ফিরে যান। অনুমিত হচ্ছে সেই গঙ্গাঋদ্ধি জাতি বা রাজ্যে ছিল উয়ারী-বটেশ্বর। দ্বিস্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা প্রাচীর, সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত প্রাচীন বসতি, আড়াই হাজার বছর সময়কাল ও পূর্ব ভারতে উয়ারী-বটেশ্বরের ভৌগোলিক অবস্থান প্রভৃতি একে গঙ্গাঋদ্ধি শনাক্ত করতে রসদ জোগায়।
উয়ারী-বটেশ্বরে আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম চিত্রশিল্প। মৃৎপাত্র, পাথর ও কাচের পুঁতিতে বিচিত্র চিত্রশিল্প ফুটে উঠেছে। উয়ারী-বটেশ্বরের মানুষ উন্নত শিল্পবোধ ও দর্শনের অধিকারী ছিল। প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বরের মানুষ অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বন্যামুক্ত প্লাইস্টোসিন ভূমিতে কিন্তু নদীতীরে বসতি গড়ে তুলেছে।
উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে নগর পর্যায়ের পূর্বের একটি স্তরে গর্ত-বসতি ও কৃষ্ণ-এবং-রক্তিম মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। তাই মনে করা হয় উয়ারী-বটেশ্বরে এক দিনেই নগর গড়ে ওঠেনি। আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু প্রমাণ করে উয়ারী-বটেশ্বর নগরপূর্ব তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির অধিকারী ছিল। প্রসঙ্গত, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ফসিল-উড ও পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যায়, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্নবস্তু। হাতিয়ারগুলো দৈবাৎপ্রাপ্ত এবং গবেষণার অভাবে এ পর্যন্ত কোনো প্রাগৈতিহাসিক বসতি স্থান সুনির্দিষ্ট করে শনাক্ত করা যায়নি। তবে বহুসংখ্যক প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার আবিষ্কার এ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানববসতির ইঙ্গিত প্রদান করে। নিবিড় অনুসন্ধান পরিচালনা করলে হয়তো একদিন প্রাগৈতিহাসিক বসতি আবিষ্কার করা সম্ভব হবে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চল থেকে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের খুবই সীমিত আর্থিক সহযোগিতায় উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা চলমান। প্রতি উৎখননে আবিষ্কৃত হচ্ছে অমূল্য তথ্যসূত্র, সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস।
ইতোমধ্যে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলের কামরাব গ্রামের মন্দির ভিটায় নির্মিত হয়েছে ‘বৌদ্ধ পদ্মমন্দির প্রত্নস্থান জাদুঘর’ এবং উয়ারী গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ‘উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ-নগর উন্মুক্ত জাদুঘর’ । দুটি জাদুঘরই ব্যতিক্রমী ধরনের উপস্থাপনা এবং বাংলাদেশে প্রথম। বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য উয়ারী-বটেশ্বরে গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ঐতিহ্য অন্বেষণের’ আবেদনের অনুকূলে নরসিংদী জেলা পরিষদকে প্রায় ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ঐতিহ্য অন্বেষণের ট্রাস্টি আবদুল কাদির মোল্লা গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর নির্মাণের জন্য প্রায় ৫ বিঘা জমি দান করেছেন। নির্মাণাধীন গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরটি হলে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ননিদর্শনসমূহ প্রদর্শনের ব্যবস্থা এবং গবেষণাকর্ম অব্যাহত রাখার সুযোগ থাকবে। উয়ারী-বটেশ্বর দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে।
উয়ারী-বটেশ্বরের ওপর দেশ-বিদেশে একাধিক প্রবন্ধ ছাড়াও এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক ‘প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য’ নামে এবং প্রথমা কর্তৃক ‘উয়ারী-বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে’ নামে দুটি গ্রন্থে।