বিপ্লব সাহা
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:১১ পিএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৩৭ পিএম
যখন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে গড়ে ওঠেনি, তখন বিবি রাসেল ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মডেল। একটা মানুষ শুধু সুযোগ পেলেই হয় না, সুযোগটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতেও জানতে হয়। তিনি যে সময়ের, তখন বাংলাদেশের মানুষ এত সচেতন ছিলেন না। এজন্য আমি দিদিমণির পরিবারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ তিনি ভিন্ন ধরনের একটি পরিবারে জন্মেছেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা, চলাফেরা নিশ্চয় অনুকূলে ছিল।
বিবি রাসেল। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। এমন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্যাশনকে তিনি নিয়ে গেছেন অন্য এক মাত্রায়। এদেশের মাটি, মানুষ, তাঁত, তাঁতি প্রতিটি বিষয় তিনি নিজের মতো করে উপলব্ধি ও অনুভব করেন। খুব সাধারণ একটি বিষয় মানুষের কাছে সহজ, সুন্দর ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। সহজ একটা কথা সহজে বলা কঠিন। তিনি তাঁর কাজের ভিতর দিয়ে সহজ ব্যাপারটি সুন্দর ও সাবলীল করে ফ্যাশনে তুলে ধরেন। তাঁর কাজের ভাষাটাই যেন আলাদা। কাজের কম্বিনেশন, প্যাটার্ন, প্রেজেন্টেশন একদমই অন্য রকম। একজন মডেলকে এমন কমপ্লিটভাবে মঞ্চে নিয়ে আসেনÑ ব্যাপারটাই অনেক আলাদা থাকে।
আমরা বাঙালিরা অনেক সময় নিজেদেরকে এমন হেয় বা ছোট করে দেখি। এমন অনেকে আছেন, যারা বিশ্বের দরবারে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয়ই দেন না। দেশের বাইরে গিয়ে আমি নিজেও অনেককে দেখেছি। এই জায়গাটাই উনি পুরো উল্টো। বাংলাদেশের মা-মাটি, তাঁত-তাঁতি, যত লোকশিল্প আছেÑ সবার সামনে দারুণভাবে তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে বেশি দেখা যায় গ্রামীণচেক, গামছা ও খাদি। তাঁর এই গুণের কারণে আমরাও কাজের আগ্রহ পাই। এটি সত্যিই গর্ব করার মতো। তাঁর কাজগুলো তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। তাই তাঁকে নিয়ে কারোর সঙ্গেই তুলনা করার কিছু নেই। শুধু তাই নয়, বিশ্বের অনেকের সঙ্গে তুলনা করারও কিছু নেই। প্রত্যেকের কাজের নিজস্ব একটি ধারা থাকে। ভাষা থাকে। একটি চরিত্র থাকে। যা দেখলেই ধারণা করা যায় কাজটি কার।
লতা মঙ্গেশকারের একটি গান আছেÑ ‘মেরা আওয়াজই মেরা পেহ্চান হে’। দিদিমণির কাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম। ওনার কাজের ক্ষেত্রে লেখার প্রয়োজন হয় নাÑ এটি বিবি রাসেলের। দেখলেই বোঝা যায়Ñ বিবি রাসেলের কাজ। ওনার কাজের মধ্যে আলাদা স্বকীয়তা আছে। এর থেকে বড় সার্থকতা আর কিছুই হয় না।
১৯৭৫ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশন থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে স্নাতক প্রদর্শনীতে নিজের কল্পনায় করা ১০টি নতুন ডিজাইনের পোশাক প্রদর্শন করেন। এ পোশাকে মডেলিংও হন তিনি। পোশাকে বৈচিত্র্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানোর কারণেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন নামকরা ম্যাগাজিনের ফ্যাশন মডেলসহ ২০ বছর কাজ করেন পৃথিবীর সব নামিদামি ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে; যা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এই জায়গাটি তিনি করেছেন ইউরোপে থাকাকালীন সময়েই। ১৯৯৪ সালে দেশে এসে ‘বিবি প্রোডাকশন’ নামে নিজস্ব ফ্যাশন ব্র্যান্ড চালু করেন। যারা মডেল তারা এমনিতেই ফ্যাশনসচেতন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে সময়টাতে ফ্যাশন নিয়ে ভেবেছেন সেই সময়ে বাংলাদেশে এমন মানসিকতার বা ভাবনার লোকই ছিল না। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি অনেক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। ২০ বছর পরে কী হবে, সেই ভাবনা তিনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে তাঁর থাকত পূর্ববিশ্লেষণ। তাঁর আন্তরিকতা, বন্ধুসুলভ আচরণ, মানুষকে অনেক সহজে আপন করে নেওয়াÑ এ বিষয়গুলো সবার মধ্যে থাকে না। বাংলাদেশে অনেক প্রথিতযশা ডিজাইনার আছেন। কিন্তু খুব কম আছেন, যারা সহজে মানুষের সঙ্গে মেশেন, কথা বলেন। বাংলা, বাংলার মানুষ এবং সংস্কৃতিকে এত সুন্দর করে দিদিমণি ফুটিয়ে তোলেন। আমি মনে করি না বাংলাদেশে এমন আর একজনও আছেন।
যখন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে গড়ে ওঠেনি, তখন বিবি রাসেল ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল মডেল। একটা মানুষ শুধু সুযোগ পেলেই হয় না। সুযোগটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতেও জানতে হয়। তিনি যে সময়ের, তখন বাংলাদেশের মানুষ এত সচেতন ছিলেন না। এজন্য আমি দিদিমণির পরিবারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ তিনি ভিন্ন ধরনের একটি পরিবারে জন্মেছেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা, চলাফেরা নিশ্চয় অনুকূলে ছিল। যদিও আমার খুব ঘনিষ্ঠভাবে দিদিমণির সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ হয়নি। যতটুকু দেখেছি এবং জেনেছি সেটা অনেক কম। আমার ধারণা, তিনি পরিবার থেকে সেই সুযোগটা পেয়েছেন। অনেকে হয়তো যোগ্যতা থাকলেও সেই সুযোগ পান না। দিদিমণি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। সবার মেধাও সমান থাকে না। তাঁর আসলেই সেই মেধা ছিল। সবকিছু মিলিয়ে একজন বাঙালি হয়ে বিদেশের মাটিতে নিজের এবং দেশের জন্য বড় একটি অর্জন করেছেন। সেই সময়ে মডেলিং বা ফ্যাশন অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম অনেকের কাছেই ছিল অজানা।
ফ্যাশনে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বিস্তার ঘটিয়েছেন তিনি। মডেলিংয়ের সুবাদে তিনি দেশের বাইরে কাজ করার অনেক সুযোগ পেয়েছেন। যা অনেকের কাছেই ছিল চিন্তাতীত। যোগাযোগ তৈরি এবং সেটি ধরে রাখা এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এখন অনেক মডেল এবং ডিজাইনার আছেন, যারা খুব ভালো কাজ করছেন। তবুও সুযোগ যেন তাদের কাছে সোনার হরিণ। ফলে ইচ্ছা থাকলেও দেশের বাইরে কাজের বিস্তার ঘটাতে পারছে না। দিদিমণি সেই সুযোগটা পেয়েছেন। অবশ্য সুযোগ পেয়েছেন বললে ভুল হবে, অর্জন করেছেন। তিনি দেশের নয়, আন্তর্জাতিক মডেল ছিলেন। একই সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়েছেন। ওনার জন্য প্ল্যাটফর্ম একই ছিল। কাজ জানলেই সব সময় হয় না। আবার জায়গা থাকলেই কাজ দেখানো যায়Ñ এমনটাও নয়। অনেক কিছুর সংমিশ্রণে তৈরি হয় নিজস্ব একটি জায়গা। তবে অবশ্যই কাজ জানতে হবে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে নেটওয়ার্কিংও। সবার জনপ্রিয়তা এক রকম হবে না। জায়গা এবং কাজভেদে আলাদা হতেই পারে। তার সুনাম শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এ বিষয়টি কাজে লাগিয়ে দেশের সুনাম তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে। আমি মনে করি দিদিমণি অনেক ভাগ্যবতী। নিজের পড়াশোনা, পরিবারের অবস্থান, বন্ধুমহল, নেটওয়ার্কিং সবকিছুর সমন্বয়ে তিনি আজকের বিবি রাসেল। এই সবকিছু করেছেন তাঁর নিজের যোগ্যতায়। শুধু কাজ জানলেই হবে না। ভালো নেটওয়ার্কিংও থাকতে হবে। তিনি তাঁর গুণ, মেধা, শিক্ষা দিয়ে আজকের সাফল্য ছিনিয়ে এনেছেন।
গামছা ফ্যাশন তারই পথিকৃৎ। অনেকের কাজের অনুপ্রেরণা। গামছা বা রিকশা যে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হতে পারে, কেউ ভাবেইনি সে সময়ে। তাঁর সেই কালের চিন্তাভাবনা এই প্রজন্মকেও ভাবাচ্ছে। তার জন্য দিদিমণি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
তাঁর কাজের ভাষা, প্যাটার্ন একদম ভিন্ন। এজন্য তিনি আজীবন মানুষের কাছে আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে থাকবেন। তিনি ভেবেছেন দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে। দেশীয় ভাষা, কাপড়, মোটিভ সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে সাধারণ একটি কাজকে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর এই কাজগুলো মানুষকে পথ দেখিয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম এই পথ ধরে এগিয়ে যাবে। দিদিমণি এই পথ সহজ করে দিয়েছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটি চলতেই থাকবে। তিনি মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে কষ্ট করেছেন। এই প্রজন্মকে সেইটা করতে হয় না। বর্তমান প্রজন্ম নিউ মার্কেট ঘুরে গামছা কিনে বানিয়ে ফেলছে ড্রেস। এদের কয়জন যায় গ্রামে, প্রান্তরে একজন তাঁতির সঙ্গে গল্প করতে? এরা জানে না, চেনে না এবং এদেরকে সেই শিক্ষাও দেওয়া হয় না। এই প্রজন্ম জানেও না কোন কাপড় কোথায়, কীভাবে তৈরি হয়। যারা স্বপ্ন দেখে, তারা নিজেই জানতে চায় বা মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। জানতে হয়Ñ এটি কোথায়, কীভাবে তৈরি হয়, কারা এবং কেন তৈরি করে। তিনি সেই স্বপ্নটাই বহু বছর আগে দেখেছেন। সেই স্বপ্নের সঙ্গে এটাও হয়তো দিদিমণির স্বপ্ন ছিল। তাঁর কাজের একটা ধারা নিয়ে এই প্রজন্ম কাজ করবে। নিজের স্বপ্নের তাড়নায় তিনি কাজ করেছেন। যার সুফল পাচ্ছে এদেশের প্রতিটি মানুষ।
বিবি আপার কাজ আমারও খুব ভালো লাগে। কখনও কখনও চোখ আটকে যায়। একটা জায়গায় খুব মিল আমাদের। আর্ট কলেজ পড়া অবস্থায় আমি খুব উজ্জ্বল রঙ নিয়ে কাজ করতাম। যারা উজ্জ্বল রঙ পছন্দ করেন, তারা নিঃসন্দেহে তাঁর কাজের পাগল থাকবেন। যেসব বিষয়ের ওপর তিনি টেক্সচার, মোটিভ ফুটিয়ে তোলেন; রিকশা প্রিন্ট বা গামছা এগুলো আসলেই ভাবিয়ে তোলে। তিনি এত সুন্দর, সহজ করে বিষয়গুলো প্রেজেন্ট করেন। আমরা এত সহজ করে অনেকেই চিন্তা করতে পারি না। এ বিষয়টি দিদিমণিকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। এভাবেই তিনি তাঁর কাজের ধারা যুগ যুগ ধরে গড়ে চলেছেন।